২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:১৯

নতুন পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রায় বড় ঘাটতির শঙ্কা

রাজধানীর বাজার ও পাড়া-মহল্লায় বিক্রি হচ্ছে পাতাসহ পেঁয়াজ। কোথাও কোথাও অপরিপক্ব পেঁয়াজ দেখা যাচ্ছে। পেঁয়াজের দুর্মূল্যের বাজারে বেশি লাভের আশায় পুষ্ট হওয়া আগে কিংবা অসময়ে জমি থেকে পেঁয়াজ তুলে বাজারে বিক্রি করছেন কৃষকরা। কোথাও আবার খেত থেকে পেঁয়াজ চুরি হচ্ছে। এই ভয়ে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে নিশ্চিত হচ্ছেন কৃষক।

তবে অনেক কৃষক পেঁয়াজ চুরি হওয়া ঠেকাতে পাহারা দিচ্ছেন জমি। তারা পেঁয়াজ পুষ্ট করে তবে জমি থেকে তুলবেন।

পুষ্ট হওয়া আগেই জমি থেকে তুলে নেওয়ার কারণে দেশে পেঁয়াজ  উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বড় ঘাটতির আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন মহল। এমনকি উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।

সরকারি সংস্থার তথ্যমতে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি মাসে গড় চাহিদা দুই লাখ টন। দৈনিক চাহিদা সাত হাজার টনের কিছু কম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন। এই উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ৩০ ভাগ নষ্ট হয়। ফলে বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে ৮ থেকে ৯ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।

এবারের দুর্মূল্যের বাজারে যেভাবে অপুষ্ট পেঁয়াজ তোলা হচ্ছে তাতে ঘাটতির পরিমাণ বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে সরকারের উদ্বেগের কথা জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক গত শুক্রবার সংবাদিকদের বলেন, ‘পেঁয়াজ এখনো বড় হয়নি। আরও অনেক বড় হওয়া দরকার। এই ছোট পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা এটা নিয়ে শঙ্কিত। পেঁয়াজের উৎপাদন তো কমে যাবে। জানুয়ারি মাসে কী উপায় হবে?’

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন ও সাবেক বাণিজ্য-সচিব (সিনিয়র সচিব) মফিজুল ইসলাম  বলেন, ‘এভাবে অপুষ্ট পেঁয়াজ বিক্রি করলে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে পারে না।  এ পেঁয়াজ পরিপক্ব হলে পরিমাণে ও ওজনে বেশি হতো। আর পরিপক্ব হওয়ার আগে পেঁয়াজ তুললে তা বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। এমনিতেই পেঁয়াজ পচনশীল।’

দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনের এলাকা হিসেবে পরিচিত এমন কয়েকটি অঞ্চলে পেঁয়াজ চাষের জমির হাল অবস্থার খোঁজ নিয়েছে। তাতে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তোলার খবর যেমন আছে, তেমনি পেঁয়াজ পরিপক্ব করতে জমি পাহারা দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ইতিমধ্যে একটা অংশের পেঁয়াজ তুলে ফেলায় লক্ষ্যমাত্রা যে পূরণ হবে না সেটি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

দুই কারণে অপুষ্ট পেঁয়াজ তোলা হচ্ছে

বাজারে স্বাভাবিক দামের সময় খেত থেকে পেঁয়াজ চুরির ঘটনা খুব একটা ঘটতে দেখা যায়নি আগে। কিন্তু বর্তমান বাজারের উচ্চমূল্যের কারণে পেঁয়াজ এখন লোভনীয় পণ্য হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেত থেকে পেঁয়াজ চুরি খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে অনেক আতঙ্কিত কৃষক সময়ের আগেই খেত থেকে পেঁয়াজ তুলে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মাঝবাড়ি ইউনিয়নের খামারবাড়ি গ্রামের কৃষক জোনাব আলীর খেত থেকে চুরি হয় অন্তত ১০ শতাংশ জমির পেঁয়াজ। এরপর আতঙ্কে পড়েন সেখানকার কয়েক হাজার পেঁয়াজ চাষি। রাত জেগে চলছে খেত পাহারা।

খামারবাড়ি গ্রামের কৃষক খায়রুল মিয়া  বলেন, ‘আমরা পাঁচ কৃষক মিলে পেঁয়াজের চুরি ঠেকাতে খেতের মধ্যে টংঘর তুলেছি। সবাই লাঠি ও টর্চলাইট জ্বালিয়ে সারারাত বসে পাহারা দেই। আর এক সপ্তাহ পাহারা দিলেই পুরোপুরি পেঁয়াজ তোলা সম্ভব হবে। যারা একটু আগে পেঁয়াজ লাগিয়েছিল তারা এখন তুলতে পারছে।’

পেঁয়াজ চুরির ভয়ে মাঝবাড়ি ইউনিয়নের খামারবাড়ি এলাকাসহ আশপাশের বেশ কিছু কৃষক পেঁয়াজ পরিপক্ব হওয়ার আগেই বাজারে নিচ্ছেন বলে জানান তারা।

এ ছাড়া কৃষককে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তোলায় প্রলুব্ধ করছে বাজারে পেঁয়াজের উচ্চমূল্য। সাধারণত মওসুমে নতুন পেঁয়াজ ১০-১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয় কৃষককে। এখন বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকার মতো। অর্থাৎ ১৫-২০ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।

এ সময়ে বেশি লাভের আশায় খেতের একটা অংশের অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এই অপুষ্ট পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি হয় ১৫০ টাকা কেজি দরে।

রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক গোপাল কৃষ্ণ দাস ঢাকা টাইমসকে জানান, এ বছর রাজবাড়িতে ২৮ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। তার মধ্যে চার হাজার ১৫০ হেক্টর মুড়ি কাটা পেঁয়াজ। জেলায় এ বছর তিন লাখ ১১ হাজার ৬৮ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

অপুষ্ট পেঁয়াজ তুলে ফেলায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া নিয়ে শঙ্কিত গোপাল কৃষ্ণ দাস। তিনি বলেন, অপরিপক্ব পেঁয়াজ ওজনে কম। এ পেঁয়াজ এক-দুই মাস সংরক্ষণ করা যায়। এভাবে পেঁয়াজ তুলতে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। ভবিষ্যতে বড় ঘাটতির সৃষ্টি করবে।

এদিকে চলনবিল অঞ্চলে উঠতে শুরু করেছে আগাম জাতের ডাটি পেঁয়াজ (গাছ পেঁয়াজ)। কিন্তু  এ পেঁয়াজ নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষক। জমি থেকে পেঁয়াজ চুরি যাচ্ছে। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন তারা। অনেকে চুরি হওয়ার ভয়ে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন।

পেঁয়াজ চাষিরা জানান, চলনবিল এলাকার তাড়াশ, গুরুদাসপুর ও চাটমোহর উপজেলার চর অঞ্চলে পেঁয়াজ চাষ হয়ে থাকে।

এ বছর প্রতি কেজি গাছ পেঁয়াজ ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হওয়ায় লাভের মুখ দেখছেন কৃষক। কিন্তু নতুন উপদ্রপ শুরু হয়েছে- পেঁয়াজ চুরি।

তাড়াশ উপজেলার বামুনগাড়া গ্রামের পেঁয়াজ চাষি তফের আলী, নূরুল ইসলাম ও ধারাবারিষা গ্রামের কফিল উদ্দিন জানান, তাদের জমির পেঁয়াজ কয়েক রাতে বেশ কয়েকবার চুরি হয়েছে। চুরি ঠেকাতে তারা রাত জেগে জমি পাহারা দিচ্ছেন।

একই ভাবে জমি পাহারা দিচ্ছেন নাদোসৈয়দপুর, হেমনগর, চরহামকুড়িয়া, কাঁটাবাড়িসহ আরও কয়েকটি গ্রামের চাষিরা। নাদোসৈয়দপুর গ্রামের শারমিন খাতুন জানান, একটু চোখের আড়াল হলেই জমি থেকে চুরি হচ্ছে পেঁয়াজ। জমির পেঁয়াজ নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন তারা। তাই অপরিপক্ক পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন কেউ কেউ।

ধামাইচ গ্রামের বাসিন্দা প্রভাষক আবু হাশিম খোকন জানান, পেঁয়াজ চুরির ঘটনা এ অঞ্চলে এখন মুখে মুখে আলোচিত। দুর্মূল্যের বাজারে শুধু পেঁয়াজ নয়, পেঁয়াজের পাতা নিয়েও মানুষের মাঝে কাড়াকাড়ি করতে দেখা যাচ্ছে। অথচ অন্যান্য বছর এসব পেঁয়াজের পাতা জমির আইলে কৃষক এমনিতে ফেলে দিত।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বাজবাড়ী প্রতিনিধি এম মনিরুজ্জামান  ও তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি শায়লা পারভীন।]
প্রকাশ :ডিসেম্বর ৮, ২০১৯ ১:১১ অপরাহ্ণ