গত বছরের ২৯ জুলাই বাস চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের নিহত শিক্ষার্থী দিয়া মিম ও রাজীব হত্যা ঘটনায় ড্রাইভারদেকে দোষী দাবি করে দিয়ার বাবা বলেছেন, ছেলে-মেয়েগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলেছে তারা, ওদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, সেদিন ছেলে-মেয়েরা ক্লাশ শেষ করে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভাররা যদি গাড়ী স্লো করতো তাহলে রাজীব ও দিয়াকে হারাতে হতো না। অদক্ষ ড্রাইভাররা অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে ওদেরকে মেরে ফেলেছে। ড্রাইভারদের উপযুক্ত সাজা হওয়া উচিত। এ সাজা দেখে যেন অন্য ড্রাইভারের মনে ভয় আসে।
ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামীকাল রোববার ধার্য করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ দুপুরে এ রায় ঘোষণা করবেন।
রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছে নিহতের স্বজনেরা এবং রাষ্ট্রপক্ষ। অপরদিকে আসামিপক্ষ মনে করছে, তারা খালাস পাবেন।
মামলার বাদী দিয়া মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সবাই চাচ্ছে মামলায় ভালো একটা বিচার হোক, উপযুক্ত বিচার হোক। আর যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা তো ড্রাইভার না। তারা তো কোন প্রশিক্ষণ নেয়নি। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু এটা তো দুর্ঘটনা না, তারা রাজীব-দিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করেছে। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। উপযুক্ত বিচার হলে মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে। তাদের বিচার হলে অন্য ড্রাইভাররা দেখবে , তারা ভয় পাবে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকবে। অদক্ষ ড্রাইভারদের বিচার চাচ্ছি। তাদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছি।’
মিমের মা রোকসানা বেগম বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আমার মেয়েকে হারিয়ে আমি যেভাবে কাঁদছি, আর কোনো মা যেন আর এভাবে না কাঁদে, আল্লাহর কাছে আমি এ দোয়াই করি। ড্রাইভার যদি একটু সাবধানে গাড়ি চালাতো তাহলে আজ আমার এভাবে কান্না করতে হতো না। আমার মেয়ে যদি রাস্তা পার হওয়ার সময় এক্সিডেন্ট করতো , তাহলেও মনে এতোটা দুঃখ থাকতো না। মনে করতাম, হয়তো আমার মেয়েরই ভুল ছিল। হয়তো মেয়েই দেখে রাস্তা পার হতে পারেনি। কিন্তু আমার মেয়ে তো গাড়িতে উঠার জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। যেখান থেকে যাত্রীরা গাড়িতে উঠে সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। আর কোনো মায়ের কোল যেন এভাবে খালি না হয়। যাদের কারণে আমি আমার মেয়েকে হারিয়ে আমি তাদের সর্বোচ্চ সাজা চাই।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী টিএম আসাদুল সুমন বলেন, মামলাটিতে অনেক ত্রুটি আছে। মামলার ডকুমেন্টরি বিবেচনা করলে আসামিরা খালাস পাবে। আর রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটি সঠিকভাবে তদন্ত করেননি। ভিকটিমদের পোস্ট মর্টেম হয়নি। তেমন কিছু জব্দও করতে পারেননি তিনি। ভিকটিমদের বডি কার কাছে, কোথায় হস্তান্তর করেছে তাও উল্লেখ করেনি। আশা করছি আসামিরা খালাস পাবে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৯ জুলাই দুপুরে কালশী ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে ১৫/২০ জন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে ছিলেন। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস ফ্লাইওভার থেকে নামার জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় পেছন থেকে আরেকটি দ্রুত গতিসম্পন্ন জাবালে নূর বাস ওভারটেক করে সামনে আসতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাস শিক্ষার্থীদের ওপর ওঠে যায়। ওই বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান দুইজন। আহত হন ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় ২৯ জুলাই রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম মামলা দায়ের করেন।
গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উত্তর ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের পরিদর্শক কাজী শরীফুল ইসলাম ঢাকা সিএমএম আদালতে ছয়জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটটি বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩২৩, ৩২৫, ৩০৪ ও ৩৪ ধারায় দাখিল করা হয়েছে। ৩০৪ ধারা অনুযায়ী, খুন বলে গণ্য নয়, এরূপ নরহত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে মাছুম বিল্লাহর চালানো বাসটি ফ্লাইওভারের ঢালে রেলিং ও দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ওই সময় যাত্রীরা বাসটি সাবধানে চালানোর জন্য চালক ও তার সহকারীকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা যাত্রীদের অনুরোধ রাখেননি।
গত বছর ২২ অক্টোবর চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। এরপর ২৫ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত।
মামলাটিতে ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। গত ৭ অক্টোবর কারাগারে থাকা চার আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করে।
গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের জন্য ১ ডিসেম্বর তারিখ ধার্য করেন।
মামলাটিতে জাবালে নূর পরিবহনের বাসচালক মাসুম বিল্লাহ, মো. জোবায়ের সুমন, মো. জাহাঙ্গীর আলম, চালকের সহকারী মো. এনায়েত হোসেন কারাগারে আছেন। অপর আসামি চালকের সহকারী মো. আসাদ কাজী পলাতক রয়েছেন।
আসামি জাবালে নূর পরিবহনের বাসমালিক মো. শাহদাত হোসেন আকন্দের মামলার অংশের কার্যক্রম হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।