২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:২৬

তেলের দাম বাড়ালো কারা?

ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো বলছে, বাজারে তারা তেলের দাম বাড়ায়নি। বোতলের গায়ে লেখা দামেই তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তেল সরবরাহও স্বাভাবিক রয়েছে। চাহিদায়ও পরিবর্তন ঘটেনি। তারপরও বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, কোম্পানি বোতলের গায়ের দামেই তেল বিক্রি করছে সত্য। তবে বিক্রির ক্ষেত্রে মূল্যে যে ‘ছাড়’ ছিল তা বাতিল করেছে। এই ‘ছাড়’ তুলে নেওয়ায় দাম বেড়েছে।

কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘১৫ দিন আগেও দেশের সিটি ও মেঘনাসহ প্রতিটি ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানি ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৪২৫ টাকা দরে বিক্রি করেছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা তা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছেন ৪৩০ থেকে ৪৩৫ টাকা দরে। পরবর্তীতে কোম্পানিগুলো তা বাড়িয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন ৪৫২ টাকা দরে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা তা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন ৪৬০ টাকা দরে। একইভাবে রূপচাঁদা ব্রান্ডের ৫ লিটার সয়াবিন তেল পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে কোম্পানি বিক্রি করেছে ৪৩৫ থেকে ৪৫০ টাকা দরে। ছাড় তুলে দেওয়ার কারণে এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৪৬৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা তা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন ৪৭০ টাকা দরে। বাজারে বোতলের গায়ে কিন্তু ওই আগের দর ৫০০ এবং ৫৩০ টাকাই লেখা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বোতলের গায়ে লেখা দাম যাচাই করলে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে, কোম্পানি দাম বাড়িয়েছে। আসলে তো কোম্পানি প্রতি লিটারে দাম বাড়িয়েছে ৫ টাকার বেশি। কোম্পানিগুলোর এই ‘ছাড়’ দেওয়া এবং ‘ছাড়’ বাতিল দাম বাড়ানোর একটি চালাকি পদ্ধতি।’
এদিকে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে বাংলাদেশ ট্য্যারিফ কমিশন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল পরিশোধনারী কয়েকজন কোম্পানির কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান নূর উর রহমান। বৈঠকে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়নি। গত কয়েক মাস বাজারে একই দাম চলছে বলে জানালেও ‘ছাড়’ প্রত্যাহারেরর তথ্যটি বৈঠকে উপস্থাপন করেননি ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বৈঠকে জানিয়েছেন, বোতলের গায়ে লেখা দামেই বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান নূর উর রহমান জানিয়েছেন, বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ, মজুত ও মূল্য পরিস্থিতি জানতে পরিশোধনকারী কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বৈঠকে বাজারে কী কারণে তেলের দাম বেড়েছে তা জানার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির মতো কোনও কারণ তৈরি হয়নি। আমরা দাম বাড়াইনি। বোতলে লেখা দামেই ভোজ্যতেল সরবরাহ করছি।
এদিকে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন জানিয়েছেন, বাজারে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মনিটরিং চলছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে মনিটরিং টিম কাজ করছে। কেউ কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিদেশি কৃষিসেবা বিভাগ থেকে পাওয়া এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন উৎপাদন হবে এক লাখ ৫৮ হাজার টন। একই সময়ে সয়াবিন আমদানি ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়ে হবে সাড়ে ১৩ লাখ টন। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, আগামী অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানি বেড়ে ২৮ লাখ টন হবে। এর মধ্যে সয়াবিন সাড়ে নয় লাখ ও পাম তেল সাড়ে ১৮ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানি ১০ শতাংশ বেড়ে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন হবে। গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ২৪ লাখ ১৫ হাজার টন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, নগরায়ন, বেকারি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার কারণে ভোজ্যতেলের চাহিদা বাড়ছে।
ওই প্রতিবেদনে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিদিন মাথাপিছু ভোজ্যতেলের ব্যবহার ২০ থেকে ২২ গ্রাম। খোলাবাজারে ভোজ্যতেলের ৭৫ শতাংশ দখল করেছে পামতেল। তবে বোতলজাত তেলের বাজারে বড় অংশ সয়াবিন তেলের দখলে আছে। চলতি অর্থবছরে দুই লাখ ৪০ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন বাড়বে। আগামী অর্থবছরে দুই লাখ ৬০ হাজার টন উৎপাদন বাড়বে। দেশে বর্তমানে ছোট-বড় ৮০টি ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ২৯ লাখ টন ভোজ্যতেল উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে সক্ষমতার ৪৮ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে।
এদিকে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে ভোজ্যতেলের ব্যবহার ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়ে ২৮ লাখ টন হবে। আগামী অর্থবছরে হবে ৩১ লাখ টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভোজ্যতেল ব্যবহারে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা।
দেশে মোট ভোজ্যতেলের চাহিদা ৫১ দশমিক ২৭ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয়। এর মূল্য ৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আমাদের দেশে তেলজাতীয় ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন ও সূর্যমুখী প্রভৃতি চাষ হয়। এর মধ্যে সরিষা, তিল এবং সূর্যমুখী থেকেই সাধারণত তেল বানানো হয়। বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র চার ভাগে তেলের আবাদ হয়। দেশে সামান্য পরিমাণ সয়াবিন উৎপন্ন হয়, চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি নির্ভর।

প্রকাশ :নভেম্বর ২৮, ২০১৯ ১২:৪৭ অপরাহ্ণ