২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:৪০

খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ না হলে বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব নয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫ এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। বায়ু দূষণের সূচকে ঢাকার সূচক ৫০ হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু রবিবার (২৪ নভেম্বর) সূচক ছিল ২০০ থেকে ৩০০। সোমবার (১৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সূচক ছিল ১৩৮। এই দূষণ কমাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করার পাশাপাশি রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ক্ষতিকর ছয় ধরনের পদার্থের মধ্যে প্রথমেই আছে পিএম (পার্টিকুলেটেড ম্যাটার) ২.৫ অথবা ২ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রাম সাইজের ক্ষুদ্র কণা। এরপর পিএম ১০ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

কণার সাইজটা বোঝাতে হলে উদাহরণ হিসেবে বলতে হবে, মাথার চুলের ডায়ামিটারের ৬ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে ২ দশমিক ৫। এটি এত ক্ষুদ্র যা খালিচোখে দেখা যায় না। বাকি চারটির মধ্যে আছে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন, কার্বন মনো অক্সাইড এবং সিসা। এই ছয় পদার্থ ও গ্যাসের ভগ্নাংশ গড় করেই বায়ুর সূচক নির্ধারণ করা হয়। সেই সূচককে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স।

প্রসঙ্গত, ভারতের দিল্লির পর ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’ সম্প্রতি বায়ুমান সূচক (একিউআই)-বিষয়ক এক প্রতিবেদন দেয়। তাতে বলা হয়েছে, রবিবার (২৪ নভেম্বর) ঢাকাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। বায়ু দূষণের মাত্রা ছিল ১৯৪, যা দূষণের সূচক অনুযায়ী অস্বাস্থ্যকর হিসেবে গণ্য করা হয়। এই তালিকায় ১৮২ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি, এরপর চীনের চেংদু শহর এবং চতুর্থ স্থানে ছিল কলকাতা।

মার্কিন এই কোম্পানি সারা বিশ্বে বায়ুমানের যাচাই করে থাকে। বায়ুর মান সূচকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সাতটি ধাপকে বিবেচনা করা হয়েছে। অন্য দেশের জন্য আবার কিছু ধাপ আলাদাও হয়। বায়ুর এই মান সূচক যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৫০ হয়, সেক্ষেত্রে এটিকে ভালো বলা হয় বলে মনে করছে তারা।

.রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ না হলে রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধের কোনও বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ঢাকার সব রাস্তাই একযোগে খোঁড়া হচ্ছে। এতে ধূলিকণার সঙ্গে গ্যাসীয় মিশ্রণে দূষণের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। দূষিত বায়ুতে ঝুঁকি বাড়ছে জীবনের।

এয়ার ভিজ্যুয়ালের সূচক অনুযায়ী, সোমবার (২৫ নভেম্বর) ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ১৪৬ থেকে ১৫০, যা রবিবার ছিল ২০১ থেকে ৩০০ এরমধ্যে। এটি খুবই অস্বাস্থ্যকর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার  বলেন, ‘কন্সট্রাকশন কাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ইটের ভাটা এবং আবর্জনা পোড়ানোর ফলে মূল দূষণগুলো হয়ে থাকে। এছাড়া যানবাহনের কারণেও দূষণ বাড়ছে। তবে সেটি আগের তুলনায় কম।’

তিনি জানান, গত ১২ থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাপা একটি জরিপ করে। তাতে দেখা যায়, ঢাকার ৪৬টি রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে, যা সাতদিনেরও বেশি সময় ধরে খোলা অবস্থায় আছে। এর সমাধান হলো, স্বল্পমেয়াদে রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিত খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। একদিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।

এছাড়া যেখানেই খোঁড়াখুঁড়ি করবে সেখানেই পানি দিতে হবে এবং বেড়া দিতে হবে। আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। মধ্য মেয়াদে ইটের ভাটাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

পরিবেশ অধিদফতর বলছে, ঢাকার চারদিকে প্রায় ৮০০ ইটের ভাটা আছে। আমাদের হিসেবে তা আরও বেশি, প্রায় এক হাজার ১০০০। ফলে যেকোনও মৌসুমই হোক না কেন, ভাটার কালো ধোঁয়া ঢাকার বাতাসে মিশতেই থাকে। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে সমন্বয়ের মাধ্যমে সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে রাস্তা খুঁড়তে হবে। সারাবছর আলাদাভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করা যাবে না।

বায়ুদূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম। তিনি জানান, এই দূষণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার মূলত চারটি কারণ আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বেশ কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে না। দুই নম্বর কারণ হচ্ছে, ঢাকার চারদিক থেকে দূষিত বাতাস আসছে। তৃতীয়ত, ঢাকায় খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ বেড়েছে, কন্সট্রাকশনের কারণে ধূলিকণা বাড়ছে এবং চলতি মাসে ইটভাটাগুলো চালু হওয়ার কারণেই মূলত এই দূষণ আরও বেড়ে গেছে।

এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীবাসী, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

তারা আরও মনে করছেন, দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে অন্যদের পাশাপাশি গর্ভবতী নারীর হৃদরোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ-ক্যানসার, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ (সিওপিডি), নিউমোনিয়াসহ চোখের সমস্যা, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া, গর্ভবতী মা যখন দূষিত বাতাস থেকে শ্বাস নেন, তখন সন্তানের ফুসফুস ও মস্তিষ্কেও তা পৌঁছে যায়। এর ফলে গর্ভের শিশুর মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ  বলেন, ‘বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েরা ঝুঁকিতে রয়েছেন। আর গর্ভবতী মা দূষিত বাতাস থেকে শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার গর্ভের সন্তানও সেই ঝুঁকিতে পড়ছে। এসব শিশুর মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ দূষিত বাতাসের কারণে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

প্রকাশ :নভেম্বর ২৬, ২০১৯ ১২:৪৯ অপরাহ্ণ