তিনি উল্লেখ করেন, ভারত ও চীনের অর্থনীতিও এখন নিম্নমুখী। ওই দুই দেশই অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়ে গেছে। আমরাও মন্দায় পড়তে পারি। হয়তো পড়ে গেছি। রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। বিনিয়োগ হচ্ছে না। কাঁচামালের আমদানি কমে গেছে। বেকারত্ব বাড়ছে।
ড. মনসুর বলেন, বাংলাদেশ মন্দায় পড়েছে এটা স্বীকার করলে এর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। তা না হলে দেশের অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়বে। তিনি মনে করেন, মন্দা স্বীকার করে সেভাবে পলিসি নিলে এখান বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। আর স্বীকার না করলে সেভাবে পলিসি নেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে সংকট আরও বাড়তে পারে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, টানা কয়েক মাস ধরে রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। রফতানির মতই আমদানি বাণিজ্যেও নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বেড়েই চলেছে বাণিজ্য ঘাটতি। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। কমে গেছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি। শুধু তাই নয়, কমে গেছে রাজস্ব আদায়ও। মূল্যস্ফীতি এখন উর্ধ্বমুখী। ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বাড়ছে ভয়ঙ্করভাবে। পতন হতে হতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে দেশের পুঁজিবাজার।
অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকাকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মন্দার দিকেই যাচ্ছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মন্দার ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি। এ কারণে আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুতিও নিতে হবে। তার মতে,নিম্নমুখী বিভিন্ন সূচকগুলোর মধ্যে রফতানি যদি ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে বিপদ কিছুটা কম হতে পারে। তবে সেটা খুবই অনিশ্চিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সারা বিশ্বেই এখন অর্থনৈতিক মন্দাভাব বিরাজ করছে। তবে বিশ্বমন্দার প্রতিধ্বনির মধ্যেও বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত ভালো আছে। পাশের দেশ ভারত ও চীনের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমরা ভালো আছি। তিনি বলেন, বিশ্বমন্দা যেহেতু আসছে, সেহেতু আমাদের ভয় না পেয়ে মন্দা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। কীভাবে বিশ্বমন্দার প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালেও বিশ্বমন্দা এসেছিল। আমরা সেই সময় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ কারণে আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি। একইভাবে এখনও আগাম প্রস্তুতি নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা এবারও মন্দার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবো।
রফতানি খাত
কয়েক মাস ধরেই রফতানি আয় কমছে। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। আর চলতি অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে রফতানি আয় কমেছে ৭ শতাংশের মতো। সুখবর নিয়েই অর্থবছরটা শুরু হলেও দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেই ধাক্কা খায় রফতানি আয়। আগস্ট মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কমে আসে। সেপ্টেম্বরে কমে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। সার্বিক পরিস্থিতিকে খুবই খারাপ বলে মন্তব্য করেছেন রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক। তিনি বলেন, গেলো অক্টোবর মাসের ১ থেকে ২৮ অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তৈরি পোশাক রফতানি কমেছে ২২ শতাংশ। অথচ গত বছরের এই ২৮ দিনে ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
বাণিজ্য ঘাটতি
গত জুলাই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগস্ট শেষে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৯ কোটি ডলার। আর সেপ্টেম্বর শেষে এটি দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলারে।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হতাশাজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের আশানুরূপ ঋণ না পাওয়ার এই চিত্র ফুটে উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহতভাবে কমছে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ। কমতে কমতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে চাপে ফেলছে। এদিকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০১৩ সালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। অথচ তখনকার চেয়েও এখন খারাপ সময় পার করছে বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ের (২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত) কোনও একক মাসে এত কম প্রবৃদ্ধি ছিল না। এমনকি সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক আমলেও (২০০৮) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল এখনকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রত্যেক মাসেই ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। যেমন, গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে এই বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। মার্চে আরও কমে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশে নামে। এপ্রিলে দাঁড়ায় ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে। এভাবে জুলাইয়ে আরও কমে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে। আগস্টে কমে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশে দাঁড়ায়। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
লেনদেন ভারসাম্যে ফের ঘাটতি
রফতানি আয়ে বড় ধাক্কার কারণে ফের ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য-ব্যালান্স অফ পেমেন্ট। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। নিয়মিত আমদানি-রফতানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনও ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
আমদানি
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তার আগের বছরের চেয়ে আমদানি ব্যয় মাত্র ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছিল। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তা ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই তিন মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে ৮ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সার্বিক আমদানির বাণিজ্য নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। গত জুন মাসে আমদানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর আগের মাস মে মাসেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসে আমদানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। এর আগে, মার্চে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি মাত্র এক শতাংশে আটকে ছিল। আর গত ফেব্রুয়ারিতে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।
চাপে রিজার্ভ
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় কমার পরও চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়—রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। ৩০ সেপ্টেম্বরের তুলনায় আগের বছরের একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০১৭ সালের গত ২২ জুন অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এরপর প্রতিবারই আকু’র বিল শোধের পর রিজার্ভ নেমে আসে। ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি। গত ১৪ নভেম্বর রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী
পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে অক্টোবরে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা ২০১৮ সালের অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। অক্টোবরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ হয়েছে, যা গত বছর অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ০৮ শতাংশ। তবে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেশ কমেছে; ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
রাজস্ব আদায়
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম ১৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
পুঁজিবাজার
পুঁজিবাজারে মূল্যসূচক কমছেই। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। উল্টো দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ব্যাংক খাত
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই একটি তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত ৬৭৫ জন ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছেন। ফলে ঋণখেলাপি হিসেবে তাদের নাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) উল্লেখ করা হয় না। এ রকম ঋণের পরিমাণ এখন ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
রেমিট্যান্স
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য বলছে, বৈদেশিক বাণিজ্য নিম্নমুখী হলেও প্রবাসী আয় কিছুটা শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এই বছরের সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয় বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবর মাসে ১৬৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তারা। এই অংক এক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি।