যে সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশকে বারবার রক্ষা করে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সেই বনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবন নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনের এই ক্ষতি পোষাতে কম করে তিন বছর সময় লাগবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুন্দরবনের প্রতি আরও যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি চুরি করে গাছকাটা বন্ধ করতে হবে। তা না-হলে ক্ষতির এই মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সুন্দরবনকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দিলে, আর অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে, এই ক্ষতি পোষাতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে। তবে বনের ওপর চাপ বাড়ালে সহজে ক্ষতি পোষানো যাবে না।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। আর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলও প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ সুন্দরবন তার নিজের মতোই করে নেবে। শুধু এটুকু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে—যেন কেউ সেই উপড়ে পড়া গাছ সরাতে না যায়। উপড়ে পড়া গাছ থেকেই আবারও নতুন গাছের প্রাণ আসবে। কিন্তু সেই গাছ সরাতে গেলে বনের যে ইকোসিস্টেম আছে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা বনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। ফলে কেউ সুন্দরবনের ভেতরে গিয়ে গাছের ইকোসিস্টেম যেন নষ্ট না করে, সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বুলবুলের কারণে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো গাছের ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পূরণ হতে খুব বেশি হলে এক বছরের মতো সময় লাগতে পারে। তবে তার চেয়েও বড় গাছ পেতে হলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’
বন বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুলবুলের প্রভাবে সুন্দরবনের পূর্ব এবং পশ্চিমে ক্ষতিগ্রস্ত গাছের একটি হিসাব বের করা হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই ছিল ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ। গেওয়া ও সুন্দরী গাছের সংখ্যাই বেশি। মূলত শিবসা ও আড় পাঙ্গাসিয়া নদীর তীরবর্তী এলাকার গাছগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গাছের ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব নয়। নতুন করে রোপণও করা যায় না। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছগুলো প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে। গাছ কাটা না হলে এই ক্ষতি পূরণ হতে খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে, এমনটা মনে করেন সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে বন অধিদফতরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘এবার ঝড়ে চার হাজার ৪৮৯টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে পূর্ব সুন্দরবনে ৫৮৭টি, আর পশ্চিম সুন্দরবন বন বিভাগের অধীন পড়েছে তিন হাজার ৯০০টির মতো গাছ। ক্ষতিগ্রস্ত গাছের মধ্যে গেওয়া, গরান ও সুন্দরী গাছের সংখ্যা বেশি। এছাড়া, আমাদের বাগানে (সংরক্ষিত) কিছু গাছ ছিল। সেগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গাছগুলোর বয়স খুব বেশি না। বড় গাছ কম। বেশির ভাগই ছোট গাছ। মাঝারি গাছও কিছু আছে। গাছের বয়স বলা কঠিন, তবে উচ্চতা হিসেবে এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতার গাছই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘এই ক্ষতি পূরণের জন্য আলাদা করে গাছ রোপণের কোনও সুযোগ নেই। কারণ, বাইরে থেকে গাছ রোপণ করা হলে সেটি সাধারণত রাখা যায় না। প্রাকৃতিকভাবেই সেখানে গাছ হয়। তাই যদি আনকাট অর্থাৎ গাছ না কাটা হয়, তাহলেই এই ক্ষতি প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ হয়ে যাবে। আমরা আশা করছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই ক্ষতি পূরণ হয়ে যাবে।’
উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অখণ্ড বনভূমি। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারের অবস্থান বাংলাদেশে। বাকি অংশ পড়েছে ভারতের পশ্চিমবাংলার মধ্যে। সঙ্গত কারণে ঝড়ের পরপরই ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার গাছের ক্ষতি নির্ধারণ করা কঠিন বিষয়। ফলে প্রকৃত ক্ষতি আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমাদের পূর্ব বন বিভাগের প্রায় ৫৮৭টি গাছ উপড়ে গেছে। এরমধ্যে রেইনট্রি ও ঝাউ গাছ আছে। আমাদের অফিস কম্পাউন্ডের কিছু গাছ পড়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল রেইনট্রি। এছাড়া শিশু, মেহগণি, আম গাছও ছিল। আর বনের ভেতরে উপড়ে পড়া গাছের মধ্যে কিছু সুন্দরী, কিছু গেওয়া ছিল।’ তিনি বলেন, ‘গাছের বয়স নির্ধারণ করা কঠিন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত কম্পাউন্ড এলাকায় নতুন করে গাছ রোপণ করা হবে।’ উপড়ে পড়া গাছগুলো কী করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুধু লোকাল এলাকায় যেগুলো পড়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করা হবে।’ কিন্তু বনের ভেতরে যেগুলো পড়েছে, সেগুলো প্রাকৃতিকভাবেই ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে ক্ষতিপূরণের সময়ের বিষয়ে আরও বেশি আশাবাদী খুলনার সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বশিরুল আল মামুন। তার এলাকায় গাছ উপড়ে পড়ার সংখ্যা অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা ঘূর্ণিঝড় সিডরের তুলনায় কিছুই নয়। আশা করি, এই ক্ষতি পূরণ হতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে।’
সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে আছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তনের দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১ ভাগেই রয়েছে নদীনালা, খাড়ি, বিল মিলিয়ে জলাভূমি অঞ্চল। বনভূমিটি স্বনামে খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। ঝড়ে শুধু বৃক্ষই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে প্রাণীরও। যদিও এর হিসাব করা খুব সহজ কাজ নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবারই ঝড়ে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমেরে ওপরে প্রভাব পড়ে। প্রাকৃতিকভাবে এই ক্ষতি পুষিয়েও নেয় সুন্দরবন।
শিগগিরই এ ধরনের আর কোনও ঝড়ের আশঙ্কা আছে কিনা, জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, ‘নভেম্বর মাসের এখন যে কদিন আছে, এ সময় খুব কমই ঝড় হয়। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সাধারণত কোনও ঝড় হয় না। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসেও আমরা বলেছি, এই অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে এ সময় ঝড় হয় না।’