পাইকারি বাজারে কমতে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। প্রতি কেজিতে কমেছে ৫ থেকে ১০ টাকা। তবে খুচরা বাজারে এর কোনও প্রভাব পড়ছে না। রবিবারও (৩ নভেম্বর) রাজধানীর খুচরা বাজারে ১৩০ থেকে ১৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই খুচরা বাজারেও পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর ক্রেতারা বলছেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের কোনও উদ্যোগই এবার কাজে আসেনি। বাজার অস্থির হওয়ার শুরুতেই টিসিবিকে দিয়ে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি এবং তুরস্ক, মিসর, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব উদ্যোগ কোনও সুফল দেয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নভেম্বর থেকে ভারতে এবং ডিসেম্বরের শুরুতেই বাংলাদেশে নতুন পেঁয়াজ উঠবে। তখন ভারত এমনিতেই পেঁয়াজ রফতানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। এ বছর ভারতে পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি না হলে বাংলাদেশেও ভালো ফলন হবে। আমদানিকারকরা বলছেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ভারত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে। আর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে পেঁয়াজের বাজার এমনিতেই পড়ে যাবে।
এদিকে, ভারতের কর্নাটকের কৃষকদের দাবির মুখে সীমিত আকারে পেঁয়াজ রফতানির অনুমতি দিয়েছে ভারত সরকার। ২৮ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছে ভারত। এজন্য কতগুলো শর্ত মানতে হবে ভারতের ব্যবসায়ীদের। ভারতের এই পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কমে আসতে পারে বলে মনে করেন বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারণে সীমিতভাবে হলেও একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
এর আগে পেঁয়াজ সংকট ও মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত। পরে এই নির্দেশ কিছুটা শিথিল করা হয়। রফতানি বন্ধের আগে খোলা এলসির বিপরীতে পেঁয়াজ দিতে শুরু করে তারা।
বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘কর্নাটকে বিশেষ করে বেঙ্গালুরুতে পেঁয়াজের ভালো আবাদ হয়েছে। তাদের পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একারণে কৃষকরা রফতানির জন্য সরকারকে চাপ দিয়েছেন। কৃষকদের দাবির মুখে ভারত সরকার সীমিতভাবে পেঁয়াজ রফতানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক শাখা এক আদেশে সীমিতভাবে পেঁয়াজ রফতানির অনুমতির বিষয়টি জানায়। এই আদেশ চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।’
সচিব জানান, ভারত সরকার ব্যবসায়ীদের কতগুরৈা শর্ত দিয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে— শুধু কর্নাটকে উৎপাদিত ‘বেঙ্গালুরু গোলাপি পেঁয়াজ’ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রফতানির জন্য ইন্ডিয়ান হর্টিকালচার কমিশনারের অনুমতি নিতে হবে। প্রতিটি চালানে সর্বোচ্চ ৯ হাজার টন রফতানি করতে পারবে। আর এই পেঁয়াজ শুধু চেন্নাই সমুদ্রবন্দর দিয়ে রফতানি করতে হবে।
ড. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘এই স্থগিতাদেশের কারণে সীমিতভাবে হলেও বাংলাদেশের বাজারে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকার পেঁয়াজের মূল্য আয়ত্ত্বের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করছে। মেঘনা ও সিটি গ্রুপের আমদানি করা পেঁয়াজ দুয়েকদিনের মধ্যেই দেশে প্রবেশ করবে। এছাড়া, নভেম্বরের মাঝামাঝি দেশি পেঁয়াজও বাজারে উঠতে শুরু করবে। ফলে পেঁয়াজের সংকট আর থাকবে না বলে আশা করছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর শ্যামবাজারের আমদানিকারক হাজি মোহাম্মদ মাজেদ বলেন, ‘ভারতে রফতানির নিষেধাজ্ঞা আংশিক প্রত্যাহারের খবর শুনেছি। তবে এটি আমাদের জন্য ততটা সুবিধাজনক নয়। কারণ, আমি যতদূর জেনেছি, মালয়েশিয়ার জন্য এই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের জন্য নয়। বেঙ্গালুরুর গোলাপি পেঁয়াজ মালয়েশিয়ায় ভালো চলে। আর সমুদ্রপথে পেঁয়াজ আনা আমাদের জন্য কোনোভাবেই লাভজনক হবে না, অনেক খরচ হবে। এছাড়া নভেম্বরের মাঝামাঝি নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করলে হয়তো এমনিই ভারতের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার শ্যামবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। এসব বাজারে প্রতি কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা কমে বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা দরে। গত দুদিন আগেও যা বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা দরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন,সরকারের কোনও উদ্যোগই এবার পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি রোধ করতে পারেনি। ৪০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ ১৫৫ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার আগেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবিকে (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। টিসিবি ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করলেও বাজারে তা কোনও প্রভাব ফেলেনি। উল্টো দাম বেড়েছে হু হু করে। কয়েক ধাপে ৪০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ ৮০ টাকা, ১০০ টাকা, ১১০ টাকা, ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, ১৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। আর দুদিন আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ একলাফে ১৫০-১৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তুরস্ক, মিয়ানমার ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিলেও আমদানিকারকদের মধ্যে এর ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিছু পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। কিন্তু তাতেও পেঁয়াজের দাম কমেনি। জানা গেছে, সময় ও পরিবহন খরচের কথা চিন্তা করে শুরুতে আমদানিকারকরা মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেননি। পরে মেঘনা, সিটি ও এস আলম গ্রুপকে দিয়ে সরকার তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিলেও সেই পেঁয়াজ এখনও পর্যন্ত দেশে এসে পৌঁছায়নি।