সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরেও শিশুদের সংঘটিত অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন হওয়ায় বিব্রত হাইকোর্ট। এ কারণেই শিশুদের বিচারিক অধিকার নিশ্চিত করতে বারবার হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে দেশের উচ্চ আদালতকে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ‘আইনে মানা, তবু ১২১ শিশুর দণ্ড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের নজরে আনা হয়। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ‘টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ১২১টি শিশুর সন্ধান পাওয়া গেছে— যাদের দণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরা তিন মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত মেয়াদে কারাদণ্ড ভোগে করছে।’
কিন্তু আইনের বাইরে শিশুদের ওপর এমন দণ্ডারোপ দেখে বিব্রত প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘উই আর শকড’। পাশাপাশি ওইসব ভ্রাম্যমাণ আদালতের দণ্ডারোপকে অবৈধ ঘোষণাও করেন হাইকোর্ট।
আদালত পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘শিশু আদালত নিয়ে ২০১৩ সালের স্পষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু এ আইনের (শিশু আইন, ২০১৩) বাইরে গিয়ে শিশুদের বিচার বা দণ্ড দেওয়া অবৈধ।’
অথচ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ২০১৩ সালে ‘শিশু আইন’ নামে নতুন আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের ৪ নম্বর ধারায় ‘শিশু’র সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনও আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, অনুর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।’
আর শিশুদের বিচারের জন্য গঠিত আদালত বিষয়ে আইনটির ১৬ ধারার (১) উপধারায় উল্লেখ আছে— ‘শিশুদের সংঘটিত যে কোনও অপরাধের বিচার করার জন্য, প্রত্যেক জেলা সদরে শিশু-আদালত নামে এক বা একাধিক আদালত থাকবে। পাশাপাশি (২) উপধারায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (২০০০ সনের ৮ নং আইন) এর অধীন গঠিত প্রত্যেক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত শিশু আদালত হিসেবে গণ্য করার এবং কোনও জেলায় উক্তরূপ কোনও ট্রাইব্যুনাল না থাকলে, উক্ত জেলার জেলা ও দায়রা জজ স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত শিশু-আদালত হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়েছে।’
আইনের এসব সুস্পষ্ট বিধান উপেক্ষা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১২১টি শিশুকে দণ্ড দিয়েছে। তবে ১২১টি শিশুর বাইরেও যেসব শিশু ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যতীত অন্য আদালতে (শিশু আদালত ব্যতীত) দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘আমাদের দণ্ডবিধিতে ৯ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনও অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। কেননা, ৯ বছরের নীচে শিশুদের অপরাধজ্ঞান থাকে না, তাই এটা কোনও আদালতেই শাস্তিযোগ্য নয়। অথচ র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ৯ বছরের নিচের শিশুদেরও শাস্তি দিয়েছে, যা অবৈধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘৯ বছরের ওপরে এবং ১৮ বছরের নিচে সবাইকে শিশু বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এদের (৯ থেকে ১৮ বছর) বয়সী শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে তাদের অপরাধমূলক জ্ঞান বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। আর এসব শিশুর বিচার শিশু আদালত ছাড়া অন্য কোনও আদালত করতে পারে না। এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত যেটি কিনা এরইমধ্যে হাইকোর্টের রায়ে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে এবং আপিলে মামলাটি শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে, সে কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত শিশু আইন, দণ্ডবিধি না মেনে যে শাস্তি দিয়েছেন, তা অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।’
ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত শিশু আদালত আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। শিশু আইনের ওপর নজর না রেখে তারা যেহেতু সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে দণ্ড দিয়েছেন, সেহেতু এই দণ্ডকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেননা, শিশু আইন অনুসারে ‘শিশু আদালত’ ব্যতীত অন্য কোনও আদালত শিশুদের বিচার বা দণ্ড দিতে পারবে না।’