নিজস্ব প্রতিবেদক:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বর্তমান সরকারের সময়ে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ভোটের আগে আরেকটি বাজেট দেওয়ার সুযোগ পাবে সরকার। তবে সেটি বাস্তবায়নের মেয়াদ পাবে ছয় মাসের মতো। কিন্তু জনগণকে তুষ্ট করতে হলে নির্বাচনের আগে এই অর্থবছরেই বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। পূরণ করতে হবে স্বল্পমেয়াদি ভিশন-২০২১ এ দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতি। সে জন্য চাই অর্থ। সেদিক বিবেচনা করে এবার ঘোষণা দিয়েই ‘চাপাচাপির’ রাজনৈতিক বাজেট দিয়েছে সরকার। প্রস্তাব করা হয়েছে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট। বাজেটের রাজস্ব আহরণে মোটা দাগে নির্ভর করা হয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক, সঞ্চয়পত্রসহ নানা ধরনের করের ওপর।
সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলগুলো এমনও বলছে, এই বাজেটের মূল লক্ষ্যই ছিল ভোটার সন্তুষ্টি। বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ করতে গেলে জনগণের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়বে ও সে নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা হবে—সে ভাবনাও তাদের ছিল। সরকার হিসাব কষেছে, নির্বাচনের আগে শেষ অর্থবছরের অপূর্ণাঙ্গ বাজেট দিয়ে সরকার এই মুহূর্তে দেওয়া করের চাপ লাঘব করবে। পুষিয়ে দিতে পারবে ক্ষতি। নির্বাচনের আগমুহূর্তে চাপবিহীন বাজেট পেলে সন্তুষ্ট হবে মানুষ। সে বাজেটের সুফল ভোগ করতে গিয়ে ভুলে যাবে চলতি অর্থবছরের বাজেটের কথা। পুনরায় আওয়ামী লীগকে বেছে নেওয়ার কথায় ভাববে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা বলেন, সরকারের এ মেয়াদে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ফান্ড প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের হাতে সময় আছে দেড় বছরেরও কম সময়। জাতীয় নির্বাচনের আগে এটিই সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আগামী অর্থবছরে মাত্র অর্ধবার্ষিক বাজেট দিতে পারবে তারা। সে জন্য এবারের বাজেটকে টাকা নেওয়ার বড় উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার।
কিন্তু বাজেট প্রস্তাবের পর সরকারের ভোটের রাজনীতির হিসাব নিকাষে কিছুটা হলেও গরমিল দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও কিছুটা অস্বস্তিতে। বিশেষ করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো ও করপোরেট ট্যাক্স না কমানোর প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট মহল। এসব প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে দেশজুড়ে। সংসদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। সরগরম রাজনীতিও। ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বাজেট প্রস্তাবের পর থেকেই বাজেট নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনামূলক বক্তব্য দিচ্ছে। বাজেট পাসের পর জীবনযাপন ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। অর্থনীতি বিশ্লেষক ছাড়াও ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার এবং অর্থমন্ত্রীর সমালোচনায় মুখর সর্বস্তরের মানুষ। বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারকদের বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
বিশেষ করে বাজেট প্রস্তাবের পর বিতর্ক ওঠা প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর অনড় অবস্থানের ঘোষণা আরো বেশি ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন করে তুলছে মানুষকে। গত বৃহস্পতিবারও এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ভ্যাট আইনটি ২০১২ সাল থেকে ঝুলে আছে। তাদের দাবিতে বারবার পেছানো হচ্ছে। আর পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। একইসঙ্গে ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের ওপর আবগারি শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা নেই বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ‘তবে এসব ব্যাপারে সংসদে আলোচনা হচ্ছে। সংসদই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। আমার কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই’-—বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যদিও অর্থমন্ত্রী এসব প্রস্তাব থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নিতে সরকারের উচ্চমহল কিছু কিছু বিষয় সংশোধনের চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের মধ্য দিয়ে ভোটার তুষ্টির জন্য বড় প্রকল্পগুলো নির্বাচনের আগে শেষ করতে হবে। সে জন্য টাকা প্রয়োজন। সে ভাবনা থেকেই সরকার এবার ভ্যাটসহ বেশকিছু কর আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রস্তাবের পর তা নিয়ে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে, তাতে সরকার কিছুটা বিপাকে পড়েছে। বিশেষ করে ভোট রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাও করছেন তারা। আর তাই সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসেছে সরকার।
বাজেট প্রস্তাবের তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বিতর্ক ওঠা প্রস্তাবগুলো সংশোধনের আভাস দেন। গত ৪ জুন সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাজেট পেশ করা হয়েছে, সংসদে আলোচনা হবে। হয়তো কারো কিছু সমস্যা থাকতে পারে, নিশ্চয় তা দেখা হবে। বাজেটে ব্যাংকে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব সংশোধনের কথা জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে। জনগণের কোনো ধরনের ক্ষতি হয় এমন বাজেট জনবান্ধব সরকার গ্রহণ করবে না। আবগারি শুল্ক নিয়ে কোনো রাজনীতি করার সুযোগ নেই। এটা পরিবর্তন করে সহনীয় পর্যায়ে আনা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বিতর্ক ওঠা বিষয়গুলোর সুষ্ঠু সমাধান করা না গেলে শেষ পর্যন্ত তা নির্বাচনী রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপ নেবে। সেক্ষেত্রে সরকারকে বিপাকে পড়তে হতে পারে। তবে প্রস্তাবিত কিছু বিষয় নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলেও মত অনেকের। একই সঙ্গে বিশ্লেষকরা এমনও বলছেন, শেষমুহূর্তে সরকার হয়তো কিছু বিষয় সমাধান করবে। কিন্তু বাজেট থেকে ইতিবাচক রাজনৈতিক সুবিধা নিতে হলে সরকারকে শেষ বছরে এসে বাজেটে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সময়মতো প্রকল্পগুলো শেষ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকার সংকুলান এবং আগামী নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই এবারের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বাজেটে কিছু বিষয় অতি মাত্রায় বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বিশেষ করে ভ্যাট এবং আমানতের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি। এ দুইটি বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো সরকারের ভেতরেও বেশ সমালোচনা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল হওয়ায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোট নেতারা বাজেট নিয়ে বাইরে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছেন না। সরাসরি সমালোচনা করতে পারছেন না। তবে দলের বিভিন্ন ফোরাম এবং ঘরোয়া আলোচনায় এসব বিষয়ে বেশ সমালোচনা চলছে। ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিকরাও বাজেট নিয়ে দলীয় ফোরামে অনেক সমালোচনা করছে- যা সরকারের জন্য চরম বিব্রতকর।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, বাজট এখনো পাস হয়নি। সংসদে আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করে। সুতরাং, সেই মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না। বাজেটে বিতর্কিত বিষয়গুলো জনস্বার্থে সংশোধনের এখনো সুযোগ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা জানান, এমনিতেই চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। তারওপর প্রস্তাবিত বাজেটে করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগে যেমন দিন দিন অস্বস্তি বাড়ছে; তেমনি বিরোধী দলগুলো এ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চেষ্টা করছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে শেষমুহূর্তে এসে ভোট রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ তৃণমূলে এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের।
নির্বাচনের আরো দেড় বছর বাকি থাকলেও এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এসব ঘটনায় খানিকটা বিপাকে ক্ষমতাসীন দল। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেন, চালের দাম একটু বেশি, এটা গ্রহণযোগ্য না। ভ্যাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই আমাদেরকে কর ও ভ্যাট দিতে হবে। কিন্তু মানুষকে কষ্ট দিয়ে নয়। প্রধানমন্ত্রী এবং সর্বোচ্চ মহলে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এবারে নির্বাচনের বছর আমরা এমন কোনো ঝুঁকি নেব না।
এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কর প্রস্তাব নিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। ব্যাংকের আমানতের ওপর হয়তো শেষ পর্যন্ত আবগারি শুল্ক থাকবে না। কিন্তু বিষয়গুলো এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে, যাতে মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে। হয়তো বাজেট পাসের পর এমন ভুল ধারণা থাকবে না।
এই বিশ্লেষক আরো বলেন, সরকার যদি বাজেটকে ভোট রাজনীতির ইস্যু হিসেবে দেখে, তাতে সমস্যা নেই। রাজনৈতিক সরকারগুলো নানাভাবে চাইবে ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে। যেভাবে ভোট পাওয়া যায়, সেদিকেই হাঁটবে। এর জন্য যে ধরনের অর্থনৈতিক নীতিমালা দরকার, সেটাই করবে। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ভোট রাজনীতিতে সফল হতে হলে অবশ্যই সরকারকে বাজেটে নেওয়া প্রকল্পগুলো সময় মতো শেষ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্প মেয়াদ ও ব্যয় বেড়ে যায়। তা ছাড়া সরকারের শেষ মুহূর্তে এসে দুর্নীতিও বাড়ে। সরকারকে অবশ্যই সেদিকে নজর রাখতে হবে।
তবে প্রস্তাবিত বাজেট একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তাতে নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থমন্ত্রী কর আদায় করতে গিয়ে এদের পকেটে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে মানুষ উদ্বিগ্ন। সুতরাং, এ বাজেট বাস্তবায়ন হলে অবশ্যই সাধারণ মানুষ ব্যাপক চাপে পড়বে। তাদের চলতে খুব কষ্ট হবে। তা ছাড়া যেসব মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তাতে দুর্নীতির আশঙ্কা থেকে যায়। সুতরাং, সরকারকে এই বাজেটের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হলে অবশ্যই সংশোধনী আনতে হবে।
দৈনিক দেশজনতা/ এমএইচ