২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:১৬

পুড়ে যাওয়া বস্তিগুলো এখন যেমন

দেশজনতা অনলাইনঃ রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর ঝিলপাড়ের বস্তিতে আগুন লাগে গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায়। ভয়াবহ আগুনে বস্তির প্রায় ৮০ ভাগই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে বস্তির প্রায় ১১ হাজার বাসিন্দা সর্বস্ব হারান। আগুনের ঘটনার পর পুড়ে যাওয়া অংশে আর বসতি স্থাপন করতে দেননি স্থানীয় কাউন্সিলরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এ জায়গার ওপর দিয়ে রাস্তা হবে এবং বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের অন্যত্র পুনর্বাসন করা হবে।

এভাবে মিরপুর এলাকার ভাসানটেক ও হাজারীবাগের বউ বাজার বস্তি পুড়ে যাওয়ার পর সেসব জায়গায় আর বস্তি গড়ে তুলতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে পুড়ে যাওয়া অনেক বস্তিরই এখন আর অস্তিত্ব নেই। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে যেসব বস্তিতে আগুন লেগেছিল, সেগুলোতে নতুন করে আর বসতি গড়ে তুলতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান স্থানীয়রা। কিন্তু মহাখালীর সাততলা ও গুলশানের কড়াইল বস্তি এর ব্যতিক্রম। এ দু’টি বস্তিতে একাধিকবার আগুন লেগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরও সেখানে নতুন করে বস্তিঘর তোলা হয়েছে। সরেজমিনে রাজধানীর বড় কয়েকটি বস্তি ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দা, বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

মিরপুর-৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তি

মিরপুর-৬ নম্বরের ঝিলপাড় বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা পারুল বলেন, ‘আমরা পুনর্বাসন চাই। মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই। এটাই আমাদের দাবি। আমার ঘরের সব জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন অনেকেই অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। অনেকদিন প্রতিবেশীদের .সাহায্য-সহযোগিতায় চলেছি। তাছাড়া ঝিলের মাঝে ঘর তোলার মতো পরিস্থিতিও নাই। তাই আমরা অন্যের বাসায় ভাড়া থাকছি। এখন ঘরভাড়া দিতেই হিমশিম খাচ্ছি।’ একই বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা নেত্রকোনার শ্যামলা বেগম। গার্মেন্টসে চাকরি করে সংসার চালাতেন। আগুনের ঘটনায় তার ঘরটিও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন গার্মেন্টসের চাকরিটাও নেই। তিনি বলেন, ‘আগুনের ঘটনার পর আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।’

ভাষানটেক বস্তি

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) মধ্যরাতে রাজধানীর ভাষানটেকের ৩ নম্বরে জাহাঙ্গীরের বস্তিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় বস্তির আড়াই বছর বয়সী তন্ময় ও তিন মাস বয়সী ইয়াসমিন নামে দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। আগুনে এই বস্তির পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। আগুনের ঘটনার পর বস্তিবাসীদের সেখানে আর থাকতে দেওয়া হয়নি। অদ্যাবধি এই জায়গা ফাঁকা রয়েছে। তবে এ বস্তিতে হাতেগোনা কয়েকটি ঘর আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিল, সেগুলো এখনও আছে। বস্তিবাসীর দাবি, পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ করার জন্যই বস্তিতে আগুন লাগানো হয়েছে।

বস্তির পুরনো বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের উচ্ছেদের জন্য এই বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত আর ঘর তুলতে দেওয়া হয়নি।’ ভাষানটেক বস্তির জায়গাটির মালিকানা গণপূর্ত বিভাগের বলে জানান স্থানীয়রা। একই বস্তির বাসিন্দা দিনমজুর দিদার হোসেন জানান, গত ১৭ বছর ভাষানটেক বস্তিতে বসবাস করে আসছেন তিনি। আগুনে ঘর পুড়ে গেছে। নতুন করে ঘর তুলতে দেওয়া হচ্ছে না। এখন কোথায় যে আশ্রয় নেবেন তাও জানা নেই তার।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তি

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তিতে আগুন লাগে ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে। আগুনে বস্তির প্রায় ৭০টি ঘর পুড়ে যায়। এই বস্তির অবস্থান ছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমির পাশে। এখন আর সেখানে কোনও বস্তি নেই। তবে বাঁধের পাশে ছোট ছোট ঘর তুলে বসবাস করছে অনেক পরিবার। বিভিন্ন সময়ে বস্তিতে আগুন লাগার কারণে এবং ব্যক্তিমালিকানার জমিতে থাকা বস্তিগুলোও ভেঙে ভবন নির্মাণের কারণে এই এলাকায় বস্তির সংখ্যা কমে গেছে।

বেড়িবাঁধ বস্তির এক সময়ের বাসিন্দা শাহানুর  জানান, এখন আগের মতো আর বড় বস্তি নেই। তবে বেড়িবাঁধে মাঝে মাঝে এখনও বস্তিঘর আছে। প্রশাসন প্রায়ই এসব ঘর উচ্ছেদ করে।

হাজারীবাগ বউ বাজার বস্তি

রাজধানীর হাজারীবাগ থানার বউ বাজারে বালু মাঠের বস্তিতে ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর আগুন লাগে। এই বস্তিতে বাঁশ ও কাঠের তৈরি তিন শতাধিক ঘর ছিল। আগুনে পুরো বস্তিই তখন পুড়ে যায়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বস্তির জায়গার মালিক হাকিম হাজি।

হাকিম হাজির মৃত্যুর পর তার ছেলেরা জায়গাটি কয়েক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেন। ওই ব্যক্তিরা সেখানে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে খুপরি ঘর বানিয়ে বস্তি গড়ে তোলেন। তবে আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর নতুন করে আর বস্তি গড়ে তুলতে দেওয়া হয়নি। জায়গাটি এখন খালি পড়ে আছে।

কড়াইল বস্তি

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১১ বার আগুন লাগে। এরমধ্যে চারবার বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে কড়াইল বস্তির বউ বাজার ও জামাই বাজারে হাজারেরও বেশি ঘর ও দোকান পুড়ে যায়। বস্তিতে থাকা অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ থেকে এসব আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। আগুনে ক্ষতিগ্রস্তরা আবারও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়ে নতুন ঘর তুলেছেন।

কড়াইল বস্তির বউ বাজারের বাসিন্দা রুবেল  জানান, ‘২০১৭ সালে আগুনে তার কাপড়ের দোকান পুড়ে যায়। এরপর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তিনি ফের ব্যবসা শুরু করেন। এখনও সেই ঋণের বোঝা নিয়েই কাটছে তার জীবন।’ একই বস্তির জামাই বাজারের বাসিন্দা বিধুর দাস বলেন, ‘২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জামাই বাজার ইউনিটে আগুন লাগে। কিছু বোঝার আগেই সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেখানে আমার একটি দোকান ও আটটি ঘর পুড়ে যায়। আমরা কারও কাছ থেকে কোনও সহায়তা পাইনি। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে টাকা আনছি। আবার ব্যবসা শুরু করেছি। এখনও পাঁচ লাখ টাকার ঋণ বকেয়া আছে।’

সাততলা বস্তি

রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে প্রথম আগুন লাগে ২০১৫ সালে। ওই বছরের ১৫ মে ভোরে লাগা আগুনে বস্তির ২০টি ঘর পুড়ে যায়। ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর রাতে আবারও আগুন লাগে এই বস্তিতে। এদিনও শতাধিক ঘর পুড়ে যায়। এই বস্তির বাসিন্দা বাবু মিয়া  বলেন,‘২০১৫ সালের আগুনে আমার সবকিছু পুড়ে যায়। পরে মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আবারও ওই জায়গায় ঘর তুলেছি।’

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ছয় বছরে রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে ২১১টি আগুনের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৮ কোটি ২৬ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ। এরমধ্যে ২০১৮ সালে ঢাকার বস্তিগুলোতে ৩৩টি আগুনের ঘটনায় হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে ৩২টি আগুনের ঘটনায় একজন নিহত ও ১০ জন আহত হন। ২০১৬ সালে ২৭টি আগুনের ঘটনায় একজন নিহত ও তিন জন আহত হন। ২০১৫ সালে ৪৭টি আগুনের ঘটনায় তিন জন নিহত ও দুই জন আহত হন। ২০১৪ সালে বস্তিগুলোতে ৪৩টি আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জন নিহত ও একজন আহত হন। ২০১৩ সালে ২৯টি আগুনের ঘটনা ঘটলেও হতাহত ছিল না।

বস্তিতে আগুনের ঘটনা ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন  বলেন, ‘রাজধানীতে একেক বস্তিতে একেক কারণে আগুন লেগেছে। কোনও বস্তিতে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে, আবার কোনোটিতে গ্যাসের চুলা থেকে আগুন লাগে। অনেক বস্তিতে গ্যাস না থাকায় বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার করা হয়। অসতর্কতার কারণে এসব চুলা থেকেও আগুন লেগেছে অনেকবার।’

ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বস্তিগুলোতে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ রয়েছে হাজার হাজার। এমনকি গ্যাসের অবৈধ সংযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এসব নজরদারিতে না আনলে বস্তিতে আগুনের ঝুঁকি থেকেই যাবে। এছাড়া,বস্তির বাসিন্দারা এসব বিষয়ে অনেকটাই অসচেতন। যে কারণে আগুন লাগে।’

প্রকাশ :অক্টোবর ৩০, ২০১৯ ১:২২ অপরাহ্ণ