একশো রোহিঙ্গা পরিবার ভাষানচরে যেতে রাজি হওয়ায় নভেম্বর মাসে তাদের সেখানে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে একলাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হবে। তবে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা নিজ দেশ মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোথাও যেতে রাজি না হওয়ায় উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ ক্যাম্পে ভাগ হয়ে অবস্থান করছেন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘর করে বসবাসকারী এসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। নৌ-বাহিনীর মাধ্যমে চরটিকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে উন্নতমানের শেড।
এ অবস্থায় বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে চলছে মাঠ পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের মতামত গ্রহণের কাজ। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের অনেকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে সম্মতি জানিয়েছে।
টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের ডি ব্লকের রোহিঙ্গা নারী নুর বানু (৩৫) বলেন, আমরা কোথাও শান্তি পাচ্ছি না। মিয়ানমার নাগরিক হিসেবে কোন ডকুমেন্টও দেয়নি। এই কারণে আমরা যেদিকে শান্তি পাচ্ছি সেদিকে চলে যাচ্ছি। আমাদের কোন কার্ডও দিচ্ছে না, সেজন্য চলে যাচ্ছি। কেউ আমাদের জোর করে পাঠাচ্ছে না; আমরা খুশিতে চলে যাচ্ছি।
একই ব্লকের আরেক রোহিঙ্গা নারী আনোয়ারা বেগম বলেন, ঠেঙ্গারচর যেতে নাম দিয়েছি। আমাদের যদি সুবিধা হয়, ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে পারে এবং সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পায় তাহলে আমরা যাবো।
টেকনাফের লেদা ২৪ নম্বর ক্যাম্পের এমএলএস ডি ব্লক মাঝি নুর হোসেন বলেন, ভাসানচরে যেতে রোহিঙ্গাদের ১৭ পরিবার রাজি হয়েছে। এরপর যেতে রাজি হওয়া রোহিঙ্গাদের ডেকে ক্যাম্প ইনচার্জ কথা বলেন। এসময় ক্যাম্প ইনচার্জ বলেন এখানে ক্যাম্প যেহেতু থাকতে অসুবিধা হচ্ছে সেহেতু ভাসানচর থাকার জন্য নিরাপদ হবে এবং সেখানে সরকার নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে। কিন্তু যারা ভাসানচরে যেতে রাজি তারা বলছে; আগে আমাদেরকে ভাসানচরে নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে। আমরা দেখে আসার পর যদি ভাল লাগে তাহলে যাবো আর না হয় যাবো না। এরপর যেতে ইচ্ছুক ১৭ রোহিঙ্গা পরিবার ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে তালিকা জমা দেয়।
তিনি আরও বলেন, যারা যেতে ইচ্ছুক তারা সরকারের নির্দেশ মান্য করে। তারা সরকারের নির্দেশনার বাইরে যেতে চায় না। কারণ নির্যাতনের কারণে এখানে এসেছি, আমাদের কোন দেশ নেই। দেশ ছাড়া দুঃখ কষ্টে থাকা মানুষ আমরা। বাংলাদেশ সরকার আমাদের জায়গা দিয়ে রাখবে বলছে; শান্তিতে রাখবে তাহলে আমরা সরকারের কথা মানব। তবে অধিকাংশ রোহিঙ্গার দাবি ভাসানচরে নয় দ্রুত নিজ দেশে ফিরতে চায়।
টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নুরুল হক বলেন, ‘যেখানে আমাদের ভাসানচরে নিয়ে যাবে বলছে, সেখানে যেতে প্রথমে তিন ঘণ্টা যাবৎ বোট চালিয়ে জায়গায় যেতে হয়। সেখানে অসুবিধা হলে, পানি উঠে যদি কিছু হলে তখন কি হবে। এসব যে হবে না তার তো কোন গ্যারান্টি সরকার দিবে না। মানুষ যেখানে মারা যাবে সেখানে মানুষ কিভাবে যেতে চাইবে।’
টেকনাফের লেদা ক্যাম্প বি-ব্লকের ৮১ নম্বর রুমের রোহিঙ্গা শফি আলম বলেন, ‘আমাদের ঠেঙ্গারচর যেতে বলছে যাব কিভাবে। শুনার পর থেকেই ভয় লাগছে। ওখানে নিয়ে গেলে তো আমরা মরে যাব। ঠেঙ্গারচর নিয়ে যাবার চেয়েও আমাদের এখানে মেরে ফেললে অনেক ভাল হবে। আমরা কিভাবে যাবে সেখানে। এখানে টিভিতে একটু করে যা দেখেছি তা দেখে তো যা ভয়ংকর লাগছে।’
লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আবুল কাশিম (৩৭) বলেন, ঠেঙ্গারচর যাচ্ছি না কারণ হচ্ছে এটা আমাদের কোন জায়গা নয়, আমাদের দেশও নয়। ঠেঙ্গারচর যেতে হলে আমরা আমাদের দেশে চলে যাবো। ১৭ পরিবার যাচ্ছে এরা আগে আসা রোহিঙ্গা। ২০-৩৫ বছর হয়েছে এমন রোহিঙ্গারা যাবে বলছে। আমাদের যদি যেতে হয় বিশ্ব আমাদের একটা বিচার করে দিবে বলে আমরা দুইবছর পর্যন্ত এখানে রেখে দিয়েছে। বিচার হচ্ছে না বলে এখানে অবস্থান করছি। বিচারটা করে দিলে আমরা মিয়ানমারে চলে যাবো।
লেদা ক্যাম্পের বি-১২ ব্লকের রোহিঙ্গার মোহাম্মদ আইয়ুব (৫০) বলেন, আমরা মিয়ানমার থেকে এসেছি খুশিতে নয়, আমরা বেশি নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে এসেছি, আমরা কোন বাংলাদেশে থাকতে আসেনি। আমরা যে বিচারটা চাই সেটা পেলে আমরা মিয়ানমার চলে যাবো। এখন মিয়ানমারের যাওয়ার জায়গায় যদি ঠেঙ্গারচর নিয়ে যায় তাহলে আমরা দুই-একজন যেতে রাজি নয়। বিচারে যদি সবাইকে নিয়ে যায় তাহলে যাবো।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে বাধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে দাতা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। তাই এখনো তাদের কারণেই রোহিঙ্গাদের মত বদলের আশঙ্কা করছেন কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের এ নেতা।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন সাধারণ সম্পাদক এড. আয়াছুর রহমান বলেন, তাদের দেখভালের জন্য যে এনজিওরা কাজ করছে, তারা সেখানে আরাম আয়েশের ব্যবস্থা পাবে না। সেজন্য তারা ইন্ধন দিচ্ছে।
তবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, একশো রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হওয়ায় নভেম্বর মাসে তাদের স্থানান্তরের প্রস্তুতি চলছে। একটা তারিখ নির্ধারণ করে স্বেচ্ছায় যারা যাবে তাদের জন্য যা দরকার আমাদের তা আছে।
২০১৫ সালে প্রথম ভাসানচরে শরণার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৭ সালের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলে মিয়ানমার থেকে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ ভয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে।