ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে বেশ কয়েকটি পথ বা উপায় নিয়ে ভাবছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এরইমধ্যে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রশাসনের নিয়মিত সভা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আগামীতে ছোট-বড় যে সমস্যাই সৃষ্টি হোক না কেন, আমরা প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার প্রক্রিয়া চাই। আর শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটি দূর করতে আবাসিক হল, বিভাগ ও সার্বিকভাবে যোগাযোগটা বাড়াতে হবে। তারা অনেক ‘অপশন’ নিয়ে ভাবছেন। এক সপ্তাহের ভেতর সেটি ঠিক করা সম্ভব হবে। তবে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থী ও শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা বলছেন, এটা কেবল উপাচার্য বা ডিএসডব্লিউ এর একার কাজ না, এটি প্রশাসনকে বুঝতে হবে।
দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় ছাত্র কল্যাণ দফতরের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি এর আগেও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্তটি এমুহূর্তে বাস্তবায়ন দেখতে চাই, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। যারা বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা শুনতে হবে।’ এটি কারও একার পক্ষে করে ফেলা সম্ভব হবে, সেটা না ভেবে সব পক্ষের সঙ্গে বসার পরামর্শ দেন তিনি। শিক্ষার্থীরা এতদিন নির্যাতনের কথা বলেননি কেন, প্রশ্নে সাবেক এই ডিএসডব্লিউ বলেন, ‘একেবারেই বলেনি তা নয়।’
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার সময় ৩৪টি ডিসিপ্লিনারি সভায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিয়েছি। তাদের ৭০ শতাংশই ছাত্রলীগের। বিভিন্ন সময় বহিষ্কার করা শিক্ষার্থীরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ফিরে এসেছে এবং তখন তাদের চেহারা আরও বদলে গেছে। আমি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে, আমাকে বিএনপি-জামায়াত মদতদাতা হিসেবে ট্যাগ দিয়ে পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। আমি প্রশাসনের সহায়তা নিয়েই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। শিক্ষার্থীদের সহায়তা নিয়েই এখন উচিত কথায় কথায় পরীক্ষা না পেছানো, ড্রাগ ব্যবহার বন্ধ, রুম দখল করতে না দেওয়ার মতো কাজগুলো করলে পরিবেশ সুষ্ঠু হবে। আর হলে হলে কয়েকশ’ মোটরসাইকেল আছে। সেগুলো লাইসেন্স আর মালিক দেখে ফেরত দিয়ে বাকিগুলো এলাকা থেকে বের করে দেওয়া জরুরি। অনেক অপশন আছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
সামনের সময়গুলো গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ দফতরের (ডিএসডব্লিউ) ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. আবদুল বাছিত, ‘আমরা সুযোগ পেয়েছি পরিবেশ ফিরিয়ে আনার এবং আমরা এবারের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে চাই। শিক্ষার্থীরা পরামর্শ দিয়েছে, মাসে একবার বা দুইবার সবাই মিলে একটা সাধারণ সভা করার। সেটি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আপাতত দলীয় রাজনীতির কোনও সুযোগ নেই।’
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের দূরত্ব ছিল বিধায় তারা এতদিন নির্যাতনের কথা জানায়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল বাছিত বলেন, ‘তারা শিক্ষকদের শরণাপন্নই হয় না। একটা দূরত্ব ছিল। আমরা সেটা কমানোর চেষ্টা করছি। রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয় ছিল, সেজন্যও হতে পারে।’ ছাত্রলীগের দাপট বা যার ভেতর দিয়ে ক্যাম্পাস চলছিল, সেটা এখন বন্ধ হলো কিনা, প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, ‘যেই দলই করুক না কেন, সবাই আমাদের ছাত্র। তাদের ছাত্র মনে করেই কাউন্সিলিং করতে হবে। দলীয় পরিচয় বিবেচনা করে নয়।’
এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষক বলেন, ‘আবরার হত্যার পর কতগুলো তদন্ত কমিটি হয়েছে, সেসব বিষয়ে প্রশাসন স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। হলে হলে তদন্ত কমিটি হওয়ার কথা, তারা কাজ করতে পারবে কিনা, সেই নিরাপত্তা কে দেবে, তা নিয়ে আলাপ নেই। আমরা তদন্ত কমিটিতে থাকতে চাই কিনা, কেউ জানতে চায়নি। অথচ বলা হচ্ছে, তদন্ত কমিটির জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। এসবের অর্থ প্রশাসন এখনও খুব বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। যে করণীয়গুলো ভুক্তভোগীদের মাথায় আসছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে বিপদ আবারও সামনে এসে হাজির হবে। পূর্ববর্তী অভিযোগগুলোসহ দাবিদাওয়া দ্রুত সমাধান না হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে না।’
সবার উপস্থিতিতে সাধারণ সভার প্রস্তাব নিয়ে ভাবা হচ্ছে উল্লেখ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শাকিল আরেফিন বলেন, ‘সাধারণ সভা হতে হবে। সেটি নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে হতে হবে। সেখানেই আমরা ছোট-বড় যেকোনও সমস্যার সমাধান করবো একসঙ্গে। আগামীকাল হয়তো সভা শেষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।’ কয়েকটি সভা হলে এবং কিছুদিন গেলে বুঝা যাবে সেটা কার্যকর হচ্ছে কিনা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আপাতত স্টুডেন্ট ইউনিয়নও চাই না।’