আওয়ামী লীগ এবং মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৫ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর মিজান হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। বাড়ি দখল, জমি দখল, খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনেক অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। রাতারাতি বনে যান কোটিপতি। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, দলের কেউ তার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করতো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মিজান কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তবে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কোনও পদে মিজান নেই বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান বলেন, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না। যার যার নিজের কর্মকাণ্ডের ভার তাকেই বহন করতে হয়। হাবিবুর রহমান মিজান এক সময় মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকলেও তিনি এখন আর আওয়ামী লীগের কেউ নন।’
যেভাবে ‘পাগলা’ মিজান নাম
জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর খামারবাড়ি খেজুর বাগান এলাকায় ছিনতাই করতে গেলে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়া মসজিদের পাশের পুকুরে নেমে পড়েন মিজান। যাতে পুলিশ কাছে আসতে না পারে সেজন্য কাপড় ছাড়াই উপরে উঠে আসেন। তার এ ধরনের কাজের জন্য পুলিশ তাকে ‘পাগলা’ আখ্যা দেয়। তখন থেকেই এলাকায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে ‘পাগলা’ মিজান নামে।
শেখ হাসিনা হত্যা চেষ্টার অন্যতম পরিকল্পনাকারী
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন এই মিজান। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে শেখ হাসিনার ওপরে ১০/১২ জনের যে দলটি গুলি চালায়, সেটাতে উপস্থিত ছিল মিজানের ছোট ভাই মোস্তফা। এ গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবির।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সময় শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করা সাবেক এক ছাত্রনেতা বলেন, হামলা পরবর্তী সময়ে তারা নিশ্চিত হয়েছিলেন মিজানই হামলাকারীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর এলাকার ফ্রিডম পার্টির কো-অর্ডিনেটর ছিলেন।
এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশিদ ও মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা এবং নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগপত্রে মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজানকে হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অনেক অপরাধের নায়ক
অনেক অপরাধের নায়ক এই মিজান। তার নামে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা ও ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে একাধিকবার গ্রেফতার হন এই মিজান। মোহাম্মদপুর এলাকায় ভূমি দস্যু হিসেবেই তাকে চেনে সবাই। এছাড়া ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুরে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ ও তার স্ত্রী ময়িম বেগমকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করেন তিনি। তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে এ ঘটনায়ও পার পেয়ে যান।
জমি দখলকে কেন্দ্র করে গত বছর একদল সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান সংলগ্ন তুরাগ নদের ওপারে একটি রিয়েল এস্টেটের ছয় কর্মীকে গুলি এবং আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এসময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়। এ হত্যার নেপথ্যেও মিজানকে দায়ী করা হয়। মিজান শ্যামলী মাঠের পশ্চিম পাশের জমির একাংশ দখল করে বানিয়েছেন মার্কেট। সেখানে তিন শতাধিক ঘর তুলে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি।
যেভাবে আওয়ামী লীগে
১৯৯১ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর দলকে নতুন করে সাজান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিশেষ গুরুত্ব দেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ওপর। তখন নেতৃত্বে আসেন প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। প্রথমে এই দু’জনের নাম ঘোষণা করা হলে পরে তারা আওয়ামী লীগের সেই সময়ের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকা মহানগর ও বিভিন্ন থানা কমিটি দেন।
আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওই সময় একজন প্রভাবশালী নেতার (বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য) সুপারিশে মিজানকে মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ওই কমিটির সভাপতি মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আর নেই। বেঁচে আছেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি এখন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য।
মিজান কীভাবে দলে এসেছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন সঠিকভাবে মনে নেই। কেননা তখন তো অনেক থানার কমিটি একসঙ্গে করা হয়েছিল। সুনির্দিষ্টভাবে একজনের কথা মনে করা কঠিন।’