সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করে বিভিন্ন কোম্পানির অজস্র বাস। এসব বাসে চালকের পাশাপাশি সহকারী হয়ে কাজ করেন অজস্র শ্রমিক। তাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৫ থেকে ২৫ এর মধ্যে। কিন্তু নানা লাঞ্ছনা, ব্যঞ্জনা সহ্য করে দীর্ঘসময় কাজ করার পরেও তারা যে পারিশ্রমিক পান তা নামমাত্র। একদিন কাজ করার পর একদিন ছুটি পান এই শ্রমিকরা। অর্থাৎ একদিনের আয়ে দুইদিন চালাতে হয় সংসার।
পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে একজন বাসের চালকের আয় হাজার থেকে পনের শ টাকা পর্যন্ত। চালকের সহকারী পান আট শ থেকে হাজার টাকা। আর লেগুনার ক্ষেত্রে এই আয় চালক আর সহকারী মিলিয়ে হাজার থেকে হাজার টাকা।
গণপরিবহণের বিষয়ে কথা তুললেই সেখানে সমাচনার শিকার হতে হয় পরিবহণ শ্রমিকদের। বাড়তি ভাড়া আদায়, মাদক সেবন, বাজে ব্যবহারসহ আনা অভিযোগ রয়েছে এসব শ্রমিকদের ক্ষেত্রে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘসময় কাজ করার ফলে পরিবহণ শ্রমিকদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনলে তা সমাধানের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।
দিনে আট থেকে দশ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার বিধান থাকলে তা মানা হচ্ছে পরিবহণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। বরং দিনে ১৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন একেকজন পরিবহণ শ্রমিক। আর একদিন কাজ করার পর একদিন ছুটি। টানা ১৮ ঘণ্টার পরিশ্রম শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। আবার শ্রমিকদের এমন অমানবিক পরিশ্রম ঝুঁকি বয়ে আনে গণপরিবহণের যাত্রী ও পথচারীদের জন্যও।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (৪২) অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক দৈনিক দশ ঘণ্টা পর্যন্তও কাজ করতে পারবে। ধারা ১০৭ এ পরিবহণ শ্রমিকদের জন্য বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন অনুমোদিত সময়ের অতিরিক্ত কোন সময় কোন শ্রমিক কোন যানবাহনে বা একাধিক যানবাহনে কাজ করবে না বা তাদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে না।’
কিন্তু বাস্তবে এই আইনের কোনো প্রয়োগ চোখে পড়ে না। বরং বাস, মিনি বাস ও লেগুনা শ্রমিকদের একেকজন দৈনিক কাজ করেন ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা। সেক্ষেত্রে আয়ও পর্যাপ্ত নয়। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে এমন নজির নতুন নয়। রাজধানীসহ সারাদেশে এমন ঘটনা প্রায় নিয়মিত। এর কারণ হিসেবে দেখা যায়, সারারাত না ঘুমিয়ে চালক গাড়ি চালাচ্ছেন। অথবা দিনভর গাড়ি চালিয়ে চালক ক্লান্ত।
পরিবহণ শ্রমিকরা বলছেন, এই শহরের নাগরিকদের সবার যখন ঘরে ফেরা শেষ হয়, তখন ঘরের পথে ছোটেন তারা। আর এই টানা ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টার কর্মযজ্ঞের পর পকেটে হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন তারা। এরপর একদিনের ছুটি। একদিন পরে আবার সেই একই কর্মযজ্ঞ।
মিরপুর রুটের বাসচালক কাদের বলেন, ‘আমরাও তো মানুষ! সারাদিন খাটলে মাঝেমধ্যে ক্লান্ত লাগে। তখন দেখা যায়, একসিডিন (একসিডেন্ট) হয়। কি করুম! একদিন পর একদিন গাড়ি পাই। সারাদিন না চালাইলেও হয় না।’
চালকের পাশাপাশি দুর্বল হয়ে পড়েন চালকের সহকারীরাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপরিবহণে কাজ করা কখনো সহজ নয়। দিন ভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় এসব শ্রমিকদের। এসময় তাদের মস্তিস্কে বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে তাদের মেজাজ হয়ে ওঠে চড়া।
মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল রুটের বাস চালকের সহকারী রুহুল আমিন বলেন, ‘সারাদিন যাত্রীদের ক্যাচক্যাচ…ভাড়া উঠান লাগে, যাত্রী উঠাও-নামাও, সার্জেন্ট দেখা, সবই করা লাগে। কতক্ষণ মেজাজ ঠিক থাকে কন?’
তবে পরিবহণ মালিকরা বলছেন, নেশাগ্রস্ত না হলে দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করা পরিবহণ শ্রমিকদের জন্য সমস্যা নয়। রজনীগন্ধা পরিবহণের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির বলেন, ‘যারা নেশা করে এটা তাদের জন্য সমস্যা। কিন্তু নেশা না করলে সমস্যা হয় না।’
কর্মঘণ্টা কমানো হলে নতুন চালকদের জন্য সুবিধা হবে। কিন্তু দক্ষদের আয় কমে গেলে তারা আর্থিক ক্ষতিতে পড়বে বলে মনে করেন এই পরিবহণ মালিক। বলেন, ‘আগে বাসা ভাড়া, অন্য খরচ কম ছিল। এখন বেশি। যে ড্রাইভার না হেলপার ১৬, ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারে, তাদের ৮, ১০ ঘণ্টা কাজ করালে তাদের আয় কমে যাবে। এটা তাদের জন্য ক্ষতি।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গণপরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে পরিবহণ শ্রমিকদের এই বাড়তি কাজের চাপ মানবাধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলছেন মানবাধিকার কর্মী অ্যারোমা দত্ত। এ বিষয়ে পরিবহণ মালিকদের উদ্যোগই মূল ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘বিমান, জাহাজ, ট্রেনসহ কিছুতে চালক ও তাদের সহকারী নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আছে। এটা শুধু বিদেশে নয়, আমাদের দেশেও আছে। নেই কেবল গণপরিবহণের ক্ষেত্রে।’
গণপরিবহণ শ্রমিকদের জন্য দিনে চয় ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারণের প্রস্তাব অনেক আগেই তিনি বলেছেন বলে জানান। কর্মঘণ্টা নির্ধারণ হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলেও তিনি মনে করেন।