দেশজনতা অনলাইন : মাছের রাজা ইলিশ। কিন্তু রাজা মাছটিকে চিনবেন কীভাবে? কেউ হয়তো আঙুলে টিপে দেখেন। কেউবা ফুলকা দেখে শনাক্ত করেন তাজা ইলিশ। আবার কেউবা তরতাজা চেহারা দেখেই ইলিশ শনাক্ত করেন। বাজারে তো হরেক রকমের ইলিশ- মেঘনার ইলিশ, পদ্মার ইলিশ, আবার আছে সমুদ্রের ইলিশ। এর ওপর আছে নকল ইলিশ- চৌক্কা, সার্ডিন, ইত্যাদি। এত কিছুর ভিড়ে কোনটা সেরা, কোনটায় প্রকৃত স্বাদ, অথবা কোনটাই বা প্রকৃত ইলিশ এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন অনেক ক্রেতা।
ইলিশের মৌসুম এলে অনেকে সর্ষে ইলিশের আয়োজন করেন, কারও ঘরে হয় ইলিশ পোলাও। ইলিশ ভাজা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ দোপেঁয়াজা, ভাপা ইলিশ, স্মোকড ইলিশ, ইলিশের মালাইকারী- এসবও পছন্দ করেন অনেকে। ইলিশকে ঘিরে এই আয়োজন যেন বাংলার সংস্কৃতিতে একাত্ম হয়ে আছে। কিন্তু ইলিশ না চিনলে এই আয়োজন কি সফল হবে?
চোখ দেখে ইলিশ চেনা যায়। ভালো ইলিশের চোখ থাকে স্বচ্ছ। চোখ দেখাবে উজ্জ্বল। হিমাগারে রাখা ইলিশ আপনি চিনে নিতে পারবেন অতি সহজেই। কেননা, হিমাগারে রাখা ইলিশের চোখ ভিতরের দিকে ঢুকে থাকবে এবং চোখ দেখাবে ঘোলাটে। লাল চোখ ইলিশের চেয়ে নীল চোখের ইলিশের স্বাদ বেশি। লাল চোখের ইলিশ তাজা হলেও এড়িয়ে যাওয়া উচিত। ইলিশের মুখ যত সরু তার স্বাদ তত বেশি। ইলিশ কেনার আগে অবশ্যই মাছের ফুলকা ভালো করে দেখা উচিত। তাজা ইলিশের ফুলকা লালচে ভাব থাকবে। তাজা না থাকলে ফুলকায় লালচে ভাব থাকবে না। সেটা ধূসর বা বাদামি রঙ ধারণ করবে।
ইলিশ যতই সমুদ্র থেকে দূরে আসে দেহে লবণের পরিমাণ কমতে থাকে। তার স্বাদ তত বাড়ে। তাজা ইলিশের রয়েছে অন্যরকম গন্ধ। সে কারণে কেনার আগে মাছটির গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। কেবল তাজা ও ভালো ইলিশ থেকেই প্রত্যাশিত গন্ধ পাবেন। তাজা না হলে ইলিশের গন্ধ হারিয়ে যাবে। তাজা ইলিশ মাছ লোনা পানি থেকে ধরা হলে, মাছে লবণাক্ত গন্ধ থাকবে। মিঠা পানির হলে পানির মতো গন্ধ থাকবে। তবে স্বাদ বেশি হবে মিঠা পানির ইলিশে। তাজা ইলিশের দেহ থাকবে স্বাভাবিক। মাছের গায়ে চাপ দিলে স্পঞ্জ করে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু দীর্ঘদিন বরফে রাখা ইলিশ শক্ত হয়ে যাবে। তাজা ইলিশে থাকবে চকচকে রঙ। ইলিশের প্রকৃত চেহারা; রূপালী রঙের ঝিলিক পাওয়া যাবে কেবল তাজা ইলিশেই। তাজা ইলিশের দেহে থাকবে পিচ্ছিল ভাব। ধরলেই টের পাওয়া যাবে। পেট দেখেও ভালো ইলিশ চেনার সুযোগ আছে। ইলিশ হাতে নিয়ে পেটে হালকা চাপ দিলে মুখ বা ফুলকা দিয়ে রক্ত বের হলে সেটি বাদ দেয়াই ভালো। এমন হলে বুঝতে হবে এটি দীর্ঘদিন বরফে রাখা। পেট ফোলা থাকলে বুঝতে হবে পেটে ডিম আছে। যদিও ইলিশের ডিম অনেকের প্রিয়, তবুও ডিম হলে ছোট ইলিশের স্বাদ কমে যায়। কিন্তু বড় ইলিশ বিশেষ করে এক কেজির উপরে হলে কোনো সমস্যা নেই।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলেন, নদী ও সমুদ্রের দুইটি ইলিশই টর্পেডো আকারের। এক্ষেত্রে পার্থক্য বোঝার উপায় হলো- নদীর ইলিশ একটু বেঁটে খাটো হবে, আর সাগরের ইলিশ হবে সরু ও লম্বা। পার্থক্য রয়েছে রঙের দিক থেকেও। নদীর ইলিশ বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল। নদীর ইলিশ চকচকে বেশি হবে, রঙ হবে অত্যাধিক রূপালী। আর সমুদ্রের ইলিশ অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল হবে। তার মতে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার ইলিশের আকার হবে পটল আকৃতির। মাথা আর লেজ সরু আর পেটটা মোটা। নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
নদী ও সমুদ্রের ইলিশের পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, সাগরের ইলিশে থেকে নদীর ইলিশের স্বাদ ভালো। নদীতে আসার পর খাবারের কারণে ইলিশের স্বাদ বাড়ে। সাগরের ইলিশে নোনা ভাব বেশি থাকে। তাই ভালো স্বাদ পেতে নদীর ইলিশ কিনতে হবে। সাগরের ইলিশ লম্বাটে হয়। নদীর ইলিশ খাটো ও গোলাকার, রূপালী ভাব বেশি। যে নদীর পানি যত স্বচ্ছ সেই নদীর ইলিশের পিঠ তত কালচে হয়। ঘোলা নদীর ইলিশের পিঠে কালচে ভাব কম। সমুদ্রের ইলিশের চেয়ে নদীর ইলিশ স্বাদ বেশি বলেই অনেকে মনে করেন। সংশ্লিষ্টরা বলেন, সমুদ্র থেকে ইলিশ নদীতে প্রবেশের পরে নদীর উজানে অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে যখন চলে, তখন ইলিশের শরীরে ফ্যাট বা চর্বি জমা হয়। এই ফ্যাট বা তেলের জন্যই ইলিশের স্বাদ হয়। বর্ষাকালে পাওয়া ইলিশের স্বাদ বেশি হয়। লোনা পানি ও মিঠা পানিতে বসবাসের কারণেও ইলিশের স্বাদে কিছুটা পার্থক্য হয়। আর সেক্ষেত্রে নদীর ইলিশের স্বাদই বেশি হয়। আবার অনেকের মতে, ডিম ছাড়ার আগ পর্যন্ত ইলিশের স্বাদ বেশি থাকে। ডিমওয়ালা মাছের পেটি পাতলা হয়ে যায়। সেইসঙ্গে চর্বি কমে যায়। এ কারণে স্বাদ কমে যায়।