দেশজনতা অনলাইন : চার হাজার কোটি টাকার বকেয়া আদায় করতে পারছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি—তিতাস। জ্বালানি বিভাগের সহযোগিতা চেয়েও সুফল মিলছে না। বকেয়া বিল আদায়ে সম্প্রতি ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছে সহায়তা চেয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে, তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘নানামুখী হস্তক্ষেপে’র কারণে তারা বিল আদায়ে কঠোর হতে পারছেন না। আবার ঠিকমতো বিল আদায় করতে না পারার জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে বলেও তিতাসের কর্মকর্তারা জানান।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, ‘বর্তমানে গ্যাসের বকেয়া বিলের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এই বকেয়া পরিশোধে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সহযোগিতা চেয়েছে সরকার। ব্যবসায়ীরা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, বকেয়া বিল পরিশোধে তারা সহযোগিতা করবেন।’
তিতাস-সূত্র বলছে, জুলাই চলতি বছরের পর্যন্ত তিতাসের মোট বকেয়ার পরিমাণ ৩ হাজার ৯৩৬ কোটি ৩,৪০৪ লাখ টাকা। এই বকেয়া বিলের মধ্যে খাত অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি বকেয়া মিটারবিহীন আবাসিকে। এর পরিমাণ ১ হাজার ২৩৯ কোটি ৪৯৮১ লাখ টাকা। যা ৫ মাসের মোট আবাসিক বিলের সমান।
এদিকে, মিটারযুক্ত আবাসিকের বকেয়ার পরিমাণ কম। এই খাতে বকেয়ার পরিমাণ ৩৮ কোটি ৪,৪০২ লাখ টাকা। তবে, তিতাস বলছে, আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রিপেইড মিটার যুক্ত করা হচ্ছে। এরফলে গ্রাহক আগে বিল পরিশোধ করবেন। এরপরই গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পাবেন।
কেন এই বিপুল পরিমাণ বকেয়া জানতে চাইলে তিতাসের অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মনে হয় তিতাসের ৮০ ভাগ গ্রাহক খুব ভালো। তারা বাসায় চুলা জ্বালান বা না-জ্বালান, শিল্পের চাকা ঘুরুক বা না ঘুরুক, মাসের শেষে বিল পরিশোধ করে দেন। আর ২০ ভাগকে নিয়ে যত যন্ত্রণা। এই সংখ্যা অঙ্কের হিসাবে ১ লাখ ৮০ হাজার। এই গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল আদায় করা ভীষণ কঠিন। অনেক সময় কঠোর হতে গেলে ওপরের হস্তক্ষেপে থেমে যেতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘এমন সব জায়গার সুপারিশ আসে, যা আমাদের নির্দেশ পালনের মতো করেই পালন করতে হয়। ওইসব আবার প্রকাশও করা যায় না।’
তিতাস সূত্র বলছে, শিল্প কারখানাগুলোর কাছেও বকেয়ার পরিমাণ বেশি। শিল্প কারখানায় বকেয়ার পরিমাণ ৬৯৪ কোটি ৩৪০৫ লাখ টাকা, যা ৩ মাসের সমান। এছাড়া, এমন কিছু শিল্প কারখানা আছে, যেসব কারখানা আদালতে মামলা করে গ্যাসের বিলের বিপরীতে কম গ্যাস বিল পরিশোধ করছে। এ ধরনের শিল্প কারখানাগুলোর কাছে বকেয়ার পরিমাণ ৩৬৭ কোটি ৯৫৩ লাখ টাকা। যা প্রায় ৪৬ মাসের সমান। তবে, মাসের হিসাবে নিষেধাজ্ঞাধীন শিল্পের বকেয়া ৪৬ মাস। অন্য শিল্প-কারখানাগুলোর বকেয়া মাত্র ৩ মাসের সমান।
এছাড়া, সিএনজিতে ২০২ কোটি ৫,৯৫৭ লাখ (প্রায় এক মাসের সমান), ক্যাপটিভে ৪৯২ কোটি ৮৩২ লাখ টাকা (প্রায় এক মাসের সমান), বাণিজ্যিকে ১৬৪ কোটি ৫,৯৯৭ লাখ টাকা (প্রায় ১০ মাসের সমান) এবং কলোনিগুলোয় বকেয়ার পরিমাণ ৩৩ কোটি ৯৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩৬ মাসের সমান গ্যাসের বিল বকেয়া পড়ে আছে।
এছাড়া, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে বকেয়া আছে ২৪২ কোটি ৭,৮১৫ লাখ টাকা, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে বকেয়া ৪২০ কোটি ৩,২০৪ লাখ টাকা, সার কারখানায় বকেয়া ৩৯ কোটি ৮,৪৭৯ লাখ টাকা।
বিভাগ অনুযায়ী, আবার নারায়ণগঞ্জের বকেয়া বিলের পরিমাণ বেশি। জুলাই পর্যন্ত সেখানে ১ হাজার ৮৬ কোটি ২,০৪৯ লাখ টাকা। এছাড়া, ঢাকায় বকেয়ার পরিমাণ এক হাজার ৫৪ কোটি ৬,১৯৯ লাখ, গাজীপুরে ৯৯৩ কোটি ৯৬৪ লাখ টাকা, ময়মনসিংহে ৯৯ কোটি ৪,৬৯৪ লাখ টাকা।
বকেয়া আদায়ের বিষয়ে তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা বকেয়া আদায়ের চেষ্টা করছি। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় চিঠি দেওয়া হচ্ছে। বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় কিছু কিছু লাইন কেটেও দিচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন , ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া আদায়ে জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালগুলোয় চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘‘অন্য যেকোনও বিতরণ কোম্পানির তুলনায় তিতাসের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। ফলে কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। এই অবস্থায় প্রতিনিয়ত কাজ করছেন তিতাসের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। তবে, বকেয়া আদায়ের বিষয়টি সব সময় সহজ হয় না। অনেক সময় ‘নানামুখী হস্তক্ষেপের’র সম্মুখীন হই। এমনও হয়েছে, বকেয়া টাকা আদায় করতে গিয়ে এবং বকেয়া পরিশোধ না করায় লাইন কাটতে গিয়ে আমাদের কর্মকর্তাদের মারপিটও করা হয়েছে।’ এসব ক্ষেত্রে ধাওয়ার ঘটনা ঘটে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।