অনলাইন ডেস্ক:
কাতারে নিজেদের এক সেনা ঘাঁটিতে নতুন সেনাবাহিনী প্রেরণের প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে তুরস্কের সংসদ। সন্ত্রাসবাদ সমর্থনের অভিযোগ এনে বাহরাইন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মাত্র দুই দিন পরই তুরস্ক সরকারের এই পদক্ষেপ কাতারের প্রতি তুরস্কের সমর্থন নতুন করে প্রতীয়মান হল।
২০১৪ সালে এক চুক্তির অধীনে কাতারে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে তুরস্ক। এটিই মধ্যপ্রাচ্যে তুর্কিদের প্রথম সামরিক স্থাপনা। ঘাঁটিতে ৫ হাজার সেনা সদস্যের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বর্তমানে এতে মাত্র ২ শত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
বুধবার তুর্কি সংসদ আরো একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এতে তুর্কি ও কাতারি সেনাবাহিনীর যৌথ সামরিক মহড়ার বিষয়টি অনুমোদিত হয়। দুইটি প্রস্তাবই তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ (একেপি)- এর সংসদ সদস্যরা উত্থাপন করেন। তবে প্রস্তাব দুটি কাতার সংকট সৃষ্টির আগেই প্রক্রিয়াধীন ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে কাতারের সঙ্গে তুরস্কের প্রতিরক্ষাগত সম্পর্ক যে তাদের জন্য অপরিহার্য, তাই বোঝা গেল। এ ছাড়া আঞ্চলিক অস্থিরতা যে তুরস্কে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন সৃষ্টি করবে না, তাও জানা গেল। পাশাপাশি সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে তুরস্ক চলমান সংকটের মধ্যে কাতারকে আশ্বস্ত করল।
বিশ্লেষকরা বলেন, কাতারের সামরিক ঘাঁটিটি তুরস্কের জন্য নিজস্ব ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও এটি একটি প্রতীকি পদক্ষেপ, তবু এতে প্রমাণ হল তুরস্ক কাতারকে এ অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। তবে এহেন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তুরস্ক যে চলমান কূটনৈতিক সংকটে কাতারের পক্ষাবলম্বন করল, এমন ভাবাটা ভুল হবে। যদিও তুরস্ক কাতারের প্রতি সৌদি আরবের বৈদেশিক নীতি মোটেও সমর্থন করে না, তবে আঙ্কারা রিয়াদের সঙ্গে কোন ধরনের ঝামেলায় যেতে চায় না, এবং যেতে পারবেও না। কাতার সংকটের ব্যাপারে তুরস্কের নীতি হল, নিজের দুই ঘনিষ্ঠ মিত্রের মধ্যে বোঝাপড়া সৃষ্টি করা। তাই কাতারে সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটি তুরস্কের জন্য সৌদিবিরোধী পদক্ষেপ নয়। তবে নিজের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়ে চলমান সংকটকে উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে তুরস্ক তার কাতারপন্থী মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করল।
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক সংঘাত ও সমাধানের ব্যাপারে কাতার ও তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে একই শিবিরে অবস্থান নিয়েছে। দুই দেশই মিশরের বিপ্লবকে সমর্থন দিয়েছে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসির ক্ষমতায় আসার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দুই দেশই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরোধিতাকারী বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে। পাশাপাশি দুই দেশই মুসলিম ব্রাদারহুড ও হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করতে অস্বীকার করেছে। দুই দেশের দ্বিপক্ষিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় যখন তুরস্কে গত জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সময় কাতারি আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। ফিলিস্তিন, হামাস, মুসলিম ব্রাদারহুড ও মিশরের ব্যাপারে তুরস্ক ও কাতার একই কাতারে অবস্থান নিয়েছে।
এ ছাড়া ইরানের ব্যাপারে কাতার ও তুরস্ক দুই দেশই এক ‘ভারসাম্যমূলক কৌশল’ গ্রহণ করেছে। যদিও রিয়াদ তেহরানকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে, কিন্তু কাতার বা তুরস্ক ইরানের সঙ্গে এক বহুস্তরবিশিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনপুষ্ট হয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এ মুহুর্তে উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানকে একঘরে করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। কিন্তু কাতার ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী পদক্ষেপ সমর্থন না করায় সৌদি ও আমিরাতিরা একে ‘উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা’(গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’) বা জিসিসির দুর্বলতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে।
অপর দিকে তুরস্ক ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের সঙ্গে পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হলেও তাদের মধ্যকার দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক গুরুত্ব বা ব্যাপকতা হারায়নি। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই দুই প্রতিবেশী দেশ তাদের রাজনৈতিক সংঘাতকে পাশে সরিয়ে রাখছে। তাদের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইরানবিরোধী জোটে তুরস্কের ভূমিকা নিয়ে সৌদি আরবকে সন্দিহান করে তুলেছে। কিন্তু তুরস্ক সৌদি ও আমিরাতিদের ক্রমাগত চাপের মুখে ইরানের কাছ থেকে সরে আসবে না, বিশ্লেষকরা এমনটাই মন্তব্য করেছেন। আবার সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হোক, এমনটাও তুরস্ক চায় না। এক্ষেত্রে তুরস্ক কাতারের মত একই বিদেশনীতি সমর্থন করছে। ফলে তুরস্ক ও কাতার ক্রমান্বয়ে একই শিবিরের অংশে পরিণত হচ্ছে।
অন্যদিকে সৌদি আরবের সঙ্গেও তুরস্কের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তুরস্ক আন্তর্জাতিক অস্ত্রবাণিজ্যে নিজেদের অংশগ্রহণ বাড়াতে চায়। আর তাদের কাছে সৌদি আরব এক বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ বাজার। গত এপ্রিলে তুরস্ক ও সৌদি আরব পারষ্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য একটি বিশেষ দল গঠনের উদ্দেশে একটি চুক্তি সাক্ষর করেছে। এ ছাড়া অতি শীঘই আঙ্কারা রিয়াদের সঙ্গে একাধিক স্বদেশি কর্ভেট রপ্তানির ব্যাপারে চুক্তি করতে চলেছে। এটি তুরস্কের ইতিহাসে বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানি চুক্তি। এই চুক্তি ভেস্তে যাক, তুরস্ক তা মোটেও চায় না। পাশাপাশি আঙ্কারা চায় রিয়াদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে। তবে তার মানে এই নয়, তুরস্ক কাতারের সঙ্গ ত্যাগ করবে। কিন্তু সৌদিদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতেও নারাজ তুর্কিরা।
তুরস্ক উপসাগরীয় সংকটের কূটনৈতিক সমাধানে আগ্রহী। তারা সংকটের কোনো এক পক্ষে অবস্থান নিতেও চাচ্ছে না। এই সংকটে কারো জয়-পরাজয় ঘটুক বা জিসিসির ভাঙন হোক, এমনটাও চায় না তুরস্ক। বরং তারা চায় একে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে চায় যা তুরস্ক ও উপসাগরীয় দেশগুলো অভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিদের মোকাবিলা করতে পারে। এমনটাই ব্যাখা দিয়েছেন কিছু বিশ্লেষক।
তথ্যসূত্র: আলজাজিরা
দৈনিক দেশজনতা/এন আর