২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:২৯

কারাগারে চিকিৎসক সংকট কাটবে কবে?

এদিকে, বারবার চিঠি চালাচালি করেও সমাধান না পাওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিক্যাল ইউনিট গঠনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায় সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ, কারাগার ও আনসারের জন্য আলাদা মেডিক্যাল ইউনিট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। যা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও বছর দুয়েকের বেশি সময় লাগবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

কারা অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান সংকটের মধ্য দিয়েই কারাবন্দিদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। শিগগিরই এই সংকটের সমাধান হচ্ছে না।

জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা বলেন, ‘বারবার সংশ্লিষ্টদের কাছে আমাদের প্রয়োজন ও সংকটের কথা জানাচ্ছি। আমরা এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আশাবাদী। কারণ, বন্দি যারা আছে, তারা দেশের নাগরিক। অন্য নাগরিকদের যেমন চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে, বন্দিদেরও সেই অধিকার রয়েছে। আমি তাদের দায়িত্বে আছি। আমার পক্ষ থেকে বিভিন্ন সভা বা রাউন্ডটেবিলে তাদের এই সমস্যার কথা তুলে ধরছি। আমি চাই এ সমস্যার সমাধান হোক।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, ‘আমরা সব সময়ই কারাগার, পুলিশসহ অন্যদের চিকিৎসক দিয়ে সহযোগিতা করি। আমাদের নিজেরই চিকিৎসক সংকট রয়েছে। যে কারণে অন্যদের চাহিদামতো চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না।’

কারা অধিদফতরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দিদের জন্য ধারণক্ষমতা রয়েছে ৪০ হাজার ৬৬৪। কিন্তু বর্তমানে বন্দি রয়েছে ৮৮ হাজার ১৪৯ জন। যা ধারণক্ষমতা থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। এই বিপুল-সংখ্যক বন্দির জন্য চিকিৎসক মাত্র ৯ জন। তাদের মধ্যে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ জন; কাশিমপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, গাজীপুর ও কুমিল্লা কারাগারে একজন করে চিকিৎসক রয়েছেন। এছাড়া, কারা অধিদফতরে কর্মরত রয়েছেন একজন চিকিৎসক।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চিকিৎসক সংকটের চিত্র তুলে ধরে সহকারী সার্জন ডা. খুরশিদ আলম বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে সহকারী সার্জন পদ আছে ৫টি। চিকিৎসক আছেন ২ জন। দশ হাজারের বেশি বন্দিকে সেবা দিচ্ছি মাত্র দুজন চিকিৎসক। ডিপ্লোমা পোস্ট আছে তিনটি, আছেন একজন। ফার্মাসিস্ট পোস্ট আছে দুটি, আছেন একজন। এই লোকবল নিয়ে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যেতে আমাদের প্রতিনিয়তই হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

বিগত কয়েক বছরে কারাবন্দিদের জন্য চিকিৎসক চেয়ে শতাধিকবার স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে কারা অধিদফতর। কিন্তু কাজ হয়নি। তাই বিকল্প ভাবা হচ্ছে। ঠিক কী কারণে চিকিৎসক নিয়োগ হচ্ছে না, তা বলতে পারছেন না কেউ। গত আগস্ট মাসেও ১৪১ জন চিকিৎসক চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই চিকিৎসক চেয়ে চিঠি দিয়ে আসছি। গত আগস্টেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেটার কোনও জবাব পাইনি। লিখিত উত্তর পেতে হয়তো সময় লাগবে। আমরা চিঠি দেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এরপর তা পাঠানো হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। সেখানে গিয়েই সব আটকে যায়।’
এই কারা কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘কারাগারে চিকিৎসকদের কাজ করার অবাধ সুযোগ রয়েছে। চিকিৎসকরা কারাগারে কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীন। কারাগারে চিকিৎসকরা যদি বলে দেন, এই রোগীর হার্টের সমস্যা আছে, তাকে হাসপাতালে নিতে হবে, তাহলে আমাদের তাই মানতে হয়।’

কারা অধিদফতর সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, চিকিৎসক সংকটের কারণে ভোগান্তি যে হচ্ছে, তা অনেক পুরনো ব্যাপার। এই সংকটের কারণে অনেক ভিআইপি বন্দি বা প্রভাবশালীরা নানা অজুহাতে বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার নামে আয়েশে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকলে সেই সুযোগটা কমে আসতো।

কারাগারে নিয়োগ পেতে চিকিৎসকদের অনীহা রয়েছে। এই অনীহা চিকিৎসক সংকটকে আরও বাড়িয়েছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, চিকিৎসকরা বলছেন, কারা অধিদফতরে নিয়োগ পাওয়া নিয়ে অনীহা থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পদোন্নতি ও উচ্চশিক্ষার মতো সুযোগ না থাকাসহ বেশ কিছু কারণে চিকিৎসকরা কারাগারে নিয়োগ পেতে চান না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কারা চিকিৎসক জানান, কারাগারে চিকিৎসক পোস্টটি হলো ‘ব্লক পোস্ট’। যেখানে পদোন্নতি নেই, উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই, পদ-পদবি নেই, তাহলে কে নিয়োগ নিতে চাইবে?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন। ওই সময় তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিক্যাল ইউনিট গঠনের নির্দেশনা দেন। যে ইউনিটের মাধ্যমে কারা, পুলিশ, বিজিবি, হাসপাতাল ও আনসার পরিচালিত হাসপাতালগুলোর জন্য চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিক নিয়োগ দেওয়া হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ১০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি) মো. নুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মো. নুরুল ইসলামকে প্রধান করে ১৪ সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটির কয়েক দফা বৈঠকও ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমিটির লিখিত প্রতিবেদন দেওয়ার তারিখ থাকলেও প্রতিবেদন দাখিলে আরও কিছু সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (জননিরাপত্তা বিভাগ) অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি) মো. নুরুল ইসলাম।

মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আমাদের অনেক কম্পোনেন্ট রয়েছে। সব কম্পোনেন্ট থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের কাজ প্রায় শেষ। ১৫ তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার একটি কাট অব ডেট আছে। আমরা দায়িত্ব পালনান্তে লিখিত প্রতিবেদন দেবো। পুরো কাজটি টিউনিং করতে আরও পাঁচ-সাত দিন সময় লাগতে পারে। যদিও মিনিস্ট্রি ১৫ তারিখ আমাদের সময় দিয়েছিল। আশা করছি এই মাসের মধ্যে আমাদের অংশের কাজ শেষ হবে। আমরা সরকারকে একটা রূপরেখা দেবো। সরকার তখন সেটার ওপর সিদ্ধান্ত নেবে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা মেডিক্যাল ইউনিট গঠনের প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কারাগারে চিকিৎসক সংকট অনেকটাই দূর হবে বলে মনে করেন কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত আইজিপি কর্নেল আবরার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা নিজস্ব মেডিক্যাল ইউনিট গঠনের জন্য নিয়মিত মিটিং হচ্ছে, প্রক্রিয়া চলছে। এই ইউনিট হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।’

জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা বলেন, ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটির প্রেজেন্টেশনেও চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি হাইলাইটস করা হয়েছে। কেন পাওয়া যাচ্ছে না, এটা বলা দুরূহ। আমি আসার আগে একবার নিয়োগও দেওয়া হয়েছিল। কয়েকজন যোগ দিলেও বেশিরভাগ চিকিৎসক যোগ দেননি।’ পৃথক মেডিক্যাল ইউনিটের মাধ্যমে চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা, প্রমোশন, র‌্যাংক-ব্যাজের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে কারাগারের মতো জায়গাতে চিকিৎসকরা নিয়োগ পেতে আগ্রহী হবেন মনে করেন তিনি।

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯ ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ