২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:৪৫

চার বছরে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য অর্ধেকে নেমেছে

ব্যাংক খাতে তারল্যের ওপর এখন ভয়াবহ চাপ। এই চাপ সামলাতে  ধারের সংস্কৃতিতে যেতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায়ই ধার করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত চার বছরে ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য অর্ধেকে নেমে এসেছে। বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট উদ্বৃত্ত তারল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত চার বছরে ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য কমেছে ৬২ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, তারল্যের ওপর চাপ বাড়ার কারণে সুদহারও বাড়তির দিকে রয়েছে। আবার বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা এখনও ব্যাংক থেকে চাহিদামতো ঋণ পাচ্ছেন না। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের আশানুরূপ ঋণ না পাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে। ২০১৩ সালের জুনের পর এটিই সর্বনিম্ন। সেই সময় ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৬ বছরের মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান  বলেন, উদ্বৃত্ত তারল্য কমে যাওয়াতে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার বেশ খানিকটা চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। যদিও চাহিদা মতো নতুন আমানত আসছে না। এর ফলে সুদহারও বাড়তির দিকে রয়েছে। এছাড়া সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সব মিলিয়ে উদ্বৃত্ত তারল্য কমে যাচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে ভালো না থাকায় ব্যাংকগুলো এই ৬০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকার বড় অংশই স্বল্প সুদের বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করে রেখেছে। আড়াই শতাংশেরও কম সুদে ৭ দিন, ১৪ দিন ও ৩০ দিন মেয়াদে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে রেখেছে। বিদ্যমান নিয়মে, ব্যাংকগুলোর সব ধরনের তলবি ও মেয়াদি আমানতের একটি অংশ নগদে এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনে সরকারকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে বিধিবদ্ধ জমা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়। প্রচলিত ধারায় একটি ব্যাংকের বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে হয় আমানতের সাড়ে ১৮ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় ১১ শতাংশ। উভয় ধারার ব্যাংকগুলোকে নগদে রাখতে হয় সাড়ে ৫ শতাংশ। আর বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের অতিরিক্ত অংশ হচ্ছে উদ্বৃত্ত তারল্য। এর একটি অংশও বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ থাকে। বাকি অংশ ব্যাংকের ঋণযোগ্য তহবিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জুন শেষে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ১লাখ ২২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জুন শেষে এটি কমে দাঁড়ায় এক লাখ ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকায়। ২০১৮ সালের জুনে আরও কমে তা ৯৭ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর এই বছরের জুনের শেষে এসএলআর সংরক্ষণের পর ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তারল্য কমে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ঋণের টাকা ফেরত না আসা। এছাড়া নতুন আমানত আসা কমে যাওয়া ও সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণেও তারল্য কমে যাচ্ছে। যে কারণে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল তিন বছর ধরে ঋণ বাড়লেও সেইভাবে আমানত বাড়েনি। ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ঋণের তুলনায় আমানত কমেছে ২৩ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। পরের বছরে (২০১৭ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের জুন) ঋণের তুলনায় আমানত কমেছে ৪২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ঋণের তুলনায় আমানত কমেছে ৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে (২০১৬ সালের জুন থেকে ২০১৭ জুন) ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানত এসেছে ৮৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। পরের বছর (২০১৭ সালের জুন থেকে ২০১৮ জুন) ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানত এসেছে ৯০ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০১৯ জুন) ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৪ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানত এসেছে ৯৬ হাজার ২৩২ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুন শেষে আমানত ছিল ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৫ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৭২ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুন শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা।

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯ ৩:২২ অপরাহ্ণ