দেশজনতা অনলাইন : গত ৩ জানুয়ারি পুরান ঢাকার ইসলামবাগ এলাকায় আগুনে যে ছয়টি কারখানা পুড়ে যায়, তার তিনটিতে তৈরি হতো নিষিদ্ধ পলিথিন। আগুন লাগার সূচনাও এর একটিতে। ওই কারখানাগুলো আবার চালু হয়েছে। অথচ ১৭ বছর ধরে নিষিদ্ধ এই ক্ষতিকর ব্যাগ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবহার।
পুরান ঢাকার ইসলামবাগ এলাকায় এ ধরনের পলিথিন কারখানা আছে ভূরি ভূরি। গুণে শেষ করাও কঠিন। আশপাশের আরও বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়রা জানে কোথায় কোথায় বানানো হয় ব্যাগগুলো। কখনো কখনো পরিবেশ অধিদপ্তর বা বিভিন্ন বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান যে চালায় না, তা নয়। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই সেগুলো চালু হয় আবার।
ইসলামবাগ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে অধিকাংশ বাড়িতেই রয়েছে কোনো না কোনো কারখানা। এর একটি বড় অংশে তৈরি হয় পলিথিন। সেই সঙ্গে আছে অজস্র গুদাম।
একটি মহল্লার বাসিন্দারা জানান, সেখানকার প্রতি দশটি বাড়ির মধ্যে সাতটিতেই কারখানা। এর মধ্যে বেশিরভাগ কারখানাতেই পলিথিন ও প্ল্যাস্টিক পণ্য তৈরি হয়। এগুলোতে প্রায়ই আগুন লাগে। তবে স্থানীয়দের আপত্তি থাকলেও কারখানা সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে কখনোই পেরে উঠছে না তারা।
এসব পলিথিন সরবরাহ হচ্ছে বিভিন্ন ছোট-বড় বাজারে। ঢাকার বাজারগুলোতেও প্রকাশ্যে কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন আকারের পলিথিন ব্যাগ। ১৫০ থেকে ২৬০ টাকা কেজি দরে এসব ব্যাগ বিক্রির চিত্র দেখা যায় বাজারগুলোতে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থা বছরে দু-একবার অভিযান চালায় পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে। তাই অনেকটা নির্বিঘ্নে সারা বছর পলিথিন উৎপাদন ও বেচাকেনা চলে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন পলিথিন ব্যবসায়ী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা পলিথিন বিক্রি করি এটা সবাই জানে। কাস্টমার যেমন জানে, সরকারি লোকেরাও জানে। আমগো বাজার কমিটি তো জানেই। সমস্যার কী আছে?’
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পলিথিনের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান করে আসছি। কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় এটা আসে, কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় আসে না।’
‘কিন্তু আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। যখনই কোনও কারখানায় অভিযান করা হয় তখন সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।’
পুরনো পলিথিনে নতুন রূপ
কেবল পলিথিন তৈরির বিষয়টিই নয়, সে উপকরণ ব্যবহার করে এগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলো আরও বিপদের কারণ হতে পারে। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া পুরনো পলিথিন কুড়িয়ে এনে গলিয়ে তা দিয়েও বানানো হচ্ছে নতুন ব্যাগ।
গাবতলী বেড়িবাঁধের স্লুইস গেট এলাকায় পুরনো পলিথিন ব্যাগ সংগ্রহ এবং বাছাইয়ের কাজ করেন বেশ কয়েকজন কর্মী। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া নোংরা পলিথিন ব্যাগ তারা সংগ্রহ করেন। সেগুলো বাছাই ও পরিষ্কার করে একত্রে রাখেন। আর এই কাজের জন্য একেকজন শ্রমিক মাসিক পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেতন পান।
ঘটনা সেখান থেকে শুরু হয়েছিল। সেখানেই গিয়ে শেষ হচ্ছে। অর্থাৎ, পুরান ঢাকার ইসলামবাগ। কারণ পুরনো পলিথিন ব্যাগ সংগ্রহের পর তা বাছাই করে পাঠানো হয় পুরান ঢাকায়। সেখানে পুরনো পলিথিন গলিয়ে তা দিয়ে আবার তৈরি করা হচ্ছে নতুন পলিথিন ব্যাগ।
‘পলিথিন শপিং ব্যাগ’ বলতে বোঝায় পলিইথাইলিন, পলিপ্রপাইলিন বা এর কোনো যৌগ বা মিশ্রণের তৈরি কোনো ব্যাগ, ঠোঙ্গা বা অন্য কোনো ধারক। যা কোনো সামগ্রী কেনাবেচা বা কোনো কিছু রাখা বা বহনের কাজে ব্যবহার করা যায়।
ক্ষতিকর জানলেও দিন দিন এই ব্যাগের ব্যবহার বেড়েই চলছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। এ বিষয়টি সবাই জানলেও কার্যত তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। আইন বলছে, ‘সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা। আবার উভয়দণ্ড হতে পারে। আবার পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী অন্যূতম দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূতম দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে শাস্তির বিধান। এক্ষেত্রে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে অন্যূনম দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূতম দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা।
পলিথিনের ব্যবহার নেই কোথায়
আইন বলছে, পলিথিন উৎপাদক এবং বাজারজাতকরণ অবৈধ। কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে পলিথিনের ব্যবহার কোথায় নেই? নিত্যদিনের বাজারসদাই তো আছেই, এক টাকা দামের চকলেট থেকে লাখ টাকার ফ্রিজ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কিনতে গেলেও তার সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে পলিথিন।
আর এই পলিথিন ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হচ্ছে যত্রতত্র। অপচনশীল পলিথিনে ভরাট হচ্ছে পয়োনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। আর তাতে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ধূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়া চাপা পড়া পলিথিন নষ্ট করছে মাটির গুণাগুণ।