দেশজনতা অনলাইন : গত ১২ জুলাই রাত ৯টার দিকে গর্ভবতী রুম্পার শরীরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সোয়া ৯টার দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্যামলীর পপুলার হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে নেওয়ার পর জানানো হয়, সেই মুহূর্তে গাইনি চিকিৎসক নেই, আল্ট্রাসাউন্ড করারও উপায় নেই। কারণ রাত ৮টার পর আল্ট্রাসাউন্ড করার ডাক্তার চলে যান। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্যামলীর কেয়ার হাসপাতালে। সেখানেও একই পরিস্থিতি। গাইনি ও আল্ট্রাসাউন্ড করার ডাক্তার নেই। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, এই মুহূর্তে আল্ট্রাসাউন্ড করার উপায় নেই। আল্ট্রাসাউন্ড ছাড়া রোগীর সমস্যা বোঝা সম্ভব না। তাই তারা রোগ নির্ণয় করতে পারছেন না। ডাক্তার রক্তক্ষরণ বন্ধ করার ওষুধ দিয়ে পরদিন এসে আল্ট্রাসাউন্ড টেস্ট করতে বলেন। রাতে রোগীকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। এবার বাংলাদেশ মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর গাইনি বিভাগের অধীনে ভর্তি করা হয় রুম্পাকে।
রূম্পার স্বজন নওরীন আক্তার বলেন, ‘আল্ট্রাসনোগ্রাম, আল্ট্রাসাউন্ড চিকিৎসার অন্যতম একটি জরুরি এবং বেসিক বিষয়। নামি বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালে যদি রাতের বেলায় এই চিকিৎসা সেবা না পাওয়া যায় তাহলে রোগীর অবস্থা কী হবে, তারা কোথায় যাবেন। রোগ নির্ণয়ের অভাবে আমাদের যেমন ক্ষতি হয়েছে তেমন ক্ষতি তো আরও মানুষের হবে।’
রাতে কেন আল্ট্রাসনোগ্রাম ও আল্ট্রাসাউন্ড করা যাবে না তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে স্বয়ং চিকিৎসকদের মধ্যেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘এ নিয়ে আমরাও কথা বলি। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে তার সমাধান কেউ দিতে পারছেন না।’ এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের চিকিৎসক জানান, ‘নিয়ম রক্ষার জন্য অনেক কিছুই করা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- রাত ৯টার পর নারী চিকিৎসকদের হাসপাতালে রাখা সম্ভব নয় নিরাপত্তার জন্যই। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও শারীরিক লাঞ্ছনার কারণে নারী চিকিৎসকরা থাকতে চান না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটস এর আইন বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নোমান চৌধুরী বলেন, ‘কোনোভাবেই এসব বন্ধ থাকা উচিত না। একজন গর্ভবতী নারীর যখন লেবার পেইন হয় সে মুহূর্তে গর্ভের সন্তানের পজিশন, মায়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণসহ যেকোনও কারণে আল্ট্রাসাউন্ড দরকার হতে পারে-এগুলো মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি।’
তিনি বলেন, রোগীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে যেকোনো অবস্থাতেই চিকিৎসার এই বেসিক বিষয় যেমন আল্ট্রাসনোগ্রাম, আল্ট্রাসাউন্ড, এক্স-রে, ইসিজির মতো বিষয়গুলো দিনরাত ২৪ ঘণ্টা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত আমাদের দেশে এসব পরীক্ষার জন্য রোগীর পক্ষ থেকেই নারী চিকিৎসকদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেখানে দিনে-দুপুরে চিকিৎসকরা হামলার শিকার হচ্ছেন, সেখানে নারী চিকিৎসকদের নিরাপত্তা কে দেবে? সরকারি হাসপাতালগুলোতে নারী চিকিৎসকদের কোনও নিরাপত্তা নেই। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা দিনের পর দিন চিৎকার করে যাচ্ছি কিন্তু কোনও সমাধান হচ্ছে না। এ চিকিৎসক জানান, অনেক হাসপাতালে রাতের বেলায় দালালরা ঘোরাঘুরি করে থাকে। কিছু ঘটলেই রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের মারধর পর্যন্ত করে। সেই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক প্রভাব। হাসপাতালের এমন পরিবেশে পরিবার থেকেও নারীদের রাতে হাসপাতালে থাকার বিষয়ে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে অথচ যা হওয়ার কথা ছিল না।
অধ্যাপক ডা. নোমান চৌধুরী বলেন, ‘একজন নারী চিকিৎসক যখন শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়, নির্যাতিত হয়, তখন আসলে সেখানে সবকিছু গৌন হয়ে যায়। তাদের যখন আমি নিরাপত্তা দিতে পারছি না তখন আমি তাকে সেখানে থাকার জন্য নীতিগতভাবেও জোর করতে পারি না। নিরাপত্তা পাওয়া তো তার অধিকার। এখন যদি নিরাপত্তার অভাবে চিকিৎসক চলে আসেন তাহলে কী সেটা কেবলই চিকিৎসকের দায়? এটা তো রাষ্ট্রের দায়- সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া।’
এদিকে এ সমস্যা সমাধানে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য হেলথ পুলিশের ব্যবস্থা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই মন্তব্য করে চিকিৎসকরা বলছেন, ইন্ড্রাস্ট্রির জন্য যদি পুলিশ দেওয়া যেতে পারে, রেল পুলিশ দেওয়া যেতে পারে, নৌপুলিশ দেওয়া যেতে পারে, হাইওয়ে পুলিশ যদি দেওয়া হয় তাহলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় কেন হেলথ পুলিশ দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে ডা. নোমান চৌধুরী বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সঠিক নিরাপত্তা ছাড়া রাতের বেলায় আল্ট্রাসনোগ্রাম, আল্ট্রাসাউন্ড করার মতো নারী চিকিৎসক পাওয়া অসম্ভব।’
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেন রাতে আল্ট্রাসাউন্ড করা যাবে না- জানতে চাইলে হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শিবেন্দু মজুমদার বলেন, ‘সকালে কয়েকশ’ রোগী হয়, সেটা চালু থাকে আড়াইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত। কিন্তু দ্বিতীয় শিফট চালু করা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে। একই সঙ্গে রাতের বেলায় চিকিৎসকদের নিরাপত্তার অভাবও রয়েছে। আমার বিভাগে ৯৫ শতাংশই নারী চিকিৎসক, তাদের জন্য রাতের বেলা কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়া কাজ করা ভীষণ কঠিন। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় জনবল পাওয়া গেলেই এ সার্ভিস ফুলটাইম করা হবে।’
এদিকে রাতের বেলা অনকলে আল্ট্রাসাউন্ড করার মতো একজন চিকিৎসক থাকেন উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. সবুর মিয়া বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ওই চিকিৎসক সেদিন কেনও আসেননি তার ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। অবশ্যই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মানবসম্পদ বিভাগের ম্যানেজার অচিন্ত কুমার নাগকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।