২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ২:২৮

বান্ধবীর অ্যাকাউন্টে সওজ কর্মকর্তার ঘুষের টাকা জব্দ

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে (ফজলে রব্বে) অভিযোগের বিষয়টি রেকর্ড সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় সার্চিং (অনুসন্ধান) চলছে। এর আগেও তিনি একবার কমিশনে হাজিরা দিয়েছেন। দ্রুতই আবার দুদক কার্যালয়ে ডাকা হবে।’

অবসরে যাওয়া এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে অর্ধকোটি টাকা জমা পড়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বিষয়টির অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। বিষয়টি প্রথমে একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এলে তারা অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে জানতে পারে এই টাকা আসলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) বরিশালের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফজলে রব্বের। অবসরে যাওয়া ওই সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে একাধিকবার। পাশাপাশি ব্যাংকে লেনদেনের সব তথ্য প্রমাণও সংগ্রহ করে বাহিনীটি।

এই ঘটনাটির তদন্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি তথ্য পায়, ফজলে রব্বে ঘুষের একাধিক লেনদেন করেছেন তার বান্ধবীদের ব্যাংক হিসাবে। নিজের হিসাবকে পরিচ্ছন্ন রাখতে এই অভিনব কৌশল নিয়েছেন তিনি। একাধিক সরকারি চাকুরে স্ত্রীর হিসাবে ঘুষের টাকা লেনদেন বা স্ত্রীর নামে সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। আর এ কারণে একাধিক নারীকে স্বামীর অপকর্মের দায়ে কারাগারেও যেতে হয়েছে।

তবে ফজলে রব্বে নিজের স্ত্রীকে বাঁচিয়ে একাধিক নারীকে যুক্ত করেছেন ঘুষের টাকা লেনদেনে। এর তথ্য প্রমাণও আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

এই ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইদুজ্জামান বলেন, ‘ফজলে রব্বের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। তাকে (ফজলে রব্বে) নোটিশ করা হয়েছিল উনি একবার দুদকে হাজির হয়েছেন। আমরা তার বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধান এবং আইনী প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জায়গায় সার্চিং করছি। অভিযোগের বিষয়টি রেকর্ড সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। দ্রুতই তাকে আবার দুদক কার্যালয়ে ডাকা হবে। তারপর আমরা আমাদের প্রতিবেদন দাখিল করব।’

বান্ধবীর ব্যাংক একাউন্টে যে টাকা দিয়েছিলেন সেটা সবশেষ অবস্থা সম্পর্কে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিযোগে যে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছিল সেটা আদালতের নির্দেশে ব্লক করা হয়েছে। ওই একাউন্টে ৫২ লাখ টাকার মত লেনদেন ছিল। এখন ১৫-২০ লাখ টাকা মত ব্লক করা সম্ভব হয়েছে। এই মুহূর্তে এর বেশি তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আগামী সপ্তাহে আমরা একটা ব্রিফ করে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দিতে পারব।’

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ইউসিবিএল এর ইস্কাটন শাখার একাউন্টে এই অবৈধ লেনদেন হয়েছিল। নিয়ম না মেনে ব্যাংকের ম্যানেজার এই লেনদেনে সহায়তা করে বলে মনে করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এই বিষয়ে শাখাটির ব্যবস্থাপক কাজী মুজিবুল ইসলাম প্রথমে কথা বলা রাজি হননি। পরে অবশ্য কথা বলেন।

মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংকে লেনদেন হল সেই তথ্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছিল কিনা প্রশ্নে বলেন, ‘এটা অনেক আগের লেনদেন। আমি আসার আগে এই লেনদেন হয়েছে।’

ব্যবস্থাপক হিসেবে কতদিন এই শাখায় আছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি এক বছর দেড় বছরের মতো এখানে আসছি।’

তাহলে আপনার সময়ই তো এই লেনদেন হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি কিছুটা বিব্রত হন। বলেন, ‘আমি থাকাকালে হতে পারে। প্রতিটা ট্রানজেকশন তো আর ওভাবে দেখি না।’

মোটা দাগের লেনদেন হলেও কেন দেখলেন না জানতে চাইলে বলেন, ‘ওটা নিয়ে কথা বলতে হলে অফিস সময়ে কল করেন। তখন বলব।’

দুদক কত টাকা জব্দ করেছে জানতে চাইলে বলেন, ‘এসব বিষয়ে অন্য কাউকে তো বলা ঠিক না। আমরা কেন বলব? আমরা ওপেনলি এসব বলব না। তবে এই একাউন্ট ব্লক আছে। তবে দুদক এই বিষয়ে তদন্ত করছে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধান বলছে, ঘুষ লেনদেনের টাকা সওজ কর্মকর্তার বান্ধবীর একাউন্টে পাঠান তিনজন ব্যক্তি। তিনদফায় এই টাকা দেওয়া হয়। প্রথম ধাপে একজন ঠিকাদার ২৫ লাখ টাকা পাঠান। পরে দুজন ঠিকাদার ১২ লাখ ও ১৫ লাখ টাকা ওই একাউন্টে পাঠিয়েছিলেন।

সওজ কর্মকর্তার বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি  বলেন, ‘আপনি এসব তথ্য কোথা থেকে পান? খুঁজে খুঁজে আমার দুর্নীতির তথ্যটাই পেলেন?’

ব্যাংক একাউন্টে ৫২ লাখ টাকার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘এটা আমার টাকা জানলেন কেমন করে? আপনি কি দেখতে গেছেন আমার ব্যাংকে এই লেনদেন হয়েছে? আপনি দেখেছেন কি-না? যা জানেন না তা নিয়ে কেন কথা বলছেন?’

তথ্য প্রমাণ নিয়েই এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে এমন কথা বললেও রব্বের ওই বান্ধবী বলেন, ‘এর আগে একবার একটা কাজ করেছেন সেই কাজটা ঠিক করেননি। ফারদার আপনি আমাকে ফোন করে এই বিষয়ে কথা বলছেন এটা আপনি ঠিক করছেন না।’

‘আপনার ব্যাংক হিসাব তো অবৈধ লেনদেনের কারণে জব্দ করা হয়েছে’- এমন মন্তব্যে ওই নারী বলেন, ‘আপনি যেখান থেকে তথ্য নিছে সেখান থেকে নেন। আমাকে কেন কল করেছেন কেন……?। আপনি আমাকে কল করতে পারেন না………..। আপনি কেন আমাকে কল দেবেন….. বলে সংযেগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।’

অভিযুক্ত সওজ কর্মকর্তা ফজলে রব্বে হজ পালনের জন্য সৌদি আরব থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মাস দুয়েক আগেও এই বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সব বিষয়ে বক্তব্য পায়নি ।

একবার ফজলে রব্বে ফোন ধরার পর বলেন, ‘আমাকে মেরে ফেলেছে……, ‘আমাকে মেরে ফেলেছে……। তাদের বলেন- আমাকে মেরে ফেলতে। আপনার সঙ্গে সামনাসামনি সব কথা বলব। আমি ৫ তারিখ (এপ্রিল) ঢাকায় আসছি, এসে দেখা করব।’

আপনি বিভিন্ন সময় প্রেমিকাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন এমন প্রশ্নে ফজলে রব্বে বলেন, ‘জ্বি, জ্বি, জ্বি,।’

কিন্তু এরপর ফজলে রব্বে এই প্রতিবেদকের তিনটি মোবাইল ফোন নম্বর ব্লক করে দিয়েছেন।

এরপর ফজলে রব্বের কার্যালয়ে দিনভর অপেক্ষা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক আসার খবরে তিনি কার্যালয়ের বাইরে তালাবদ্ধ থাকা অবস্থায় দিনভর অফিস করেন। আর পেছনের গেট দিয়ে কোনো এক সময় বেরিয়ে যান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে কর্মকর্তারা ফজলে রব্বের একাধিক বান্ধবীর ব্যাংক হিসাবে অবৈধ লেনদেনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন, তারা এখন তার অবৈধ সম্পদেরও খোঁজ করছেন। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনকেও জানানো হবে বলে জানিয়েছেন অনুসন্ধান চালানো একজন কর্মকর্তা।

বাহিনীটি জানতে পেরেছে, বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগে কর্মরত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফজলে রব্বে বিভিন্ন সময় ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নেন। এসব টাকাই তিনি তার একাধিক মেয়ে বন্ধুকে পাঠিয়েছেন।

সওজের এই কর্মকর্তার সঙ্গে অনেক নারীর সু-সম্পর্ক রয়েছে। যার প্রমাণ আইনশৃঙ্খলাবাহিনী পেয়েছে। এর মধ্যে ‘ফা’ অদ্যাক্ষরে এক নারীর ব্যাংক হিসাবে তিন দফায় নগদ ৫২ লাখ টাকা পাঠানো হয়।

এসব অর্থ ওই নারীর বেসরকারি একটি ব্যাংক একাউন্টে পাঠানো হয় তিনজন ঠিকাদারের পক্ষ থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধান বলছে, প্রথম ধাপে একজন ঠিকাদার ২৫ লাখ টাকায় পাঠান। পরে দুজন ঠিকাদার ১২ লাখ ও ১৫ লাখ টাকা ওই একাউন্টে পাঠিয়েছিলেন।

বরিশালে যাওয়ার আগে ফজলে রব্বে গাজীপুরে নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। ২০১০-১১ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে জয়দেবপুর-মির্জাপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর সড়কে প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামতকাজ করান। মান বজায় রেখে কাজ করা হয়নি- এ অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ফজলে রব্বেকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দেয়। সে সময় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ একটি শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না শর্তে  বলেন, ‘সম্প্রতি একজন নারীর ব্যাংক একাউন্টে অসঙ্গতিপূর্ণ লেনদেন দেখে একাউন্ট মালিককে ডাকা হয়। তিনি স্বামীসহ আমাদের কার্যালয়ে আসেন। তার একাউন্টে অর্ধকোটি টাকার বেশি লেনদেন বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে টাকাগুলো নিজ পরিবারের বলে দাবি করেন। এ সময় তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করা হলে- তিনি টাকার বিষয় কিছু জানেন না বলে জানায়। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হলে ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’

‘পরে জানা যায়, তার সঙ্গে সওজ কর্মকর্তার সম্পর্কের কারণে তাকে দিয়েছে। সওজ কর্মকর্তা ফজলে রব্বেকে ডাকা হয়। কিন্তু নানান টালবাহানা করে সে আসতে রাজি হচ্ছিলেন না; পরে অবশ্য আসতে বাধ্য হন। কেন তিনি এত টাকা তার প্রেমিকার ব্যাংক একাউন্টে দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি (ফজলে রব্বে) জানান- টাকাগুলো ঘুষের ছিল। আর ওই নারীর সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের চেনাজানা। কর্মস্থল থেকে ছুটিতে ঢাকায় আসলেই তারা দেখা করেন। তাই টাকাগুলো দিয়েছেন।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটির আরেকজন কর্মকর্তা  জানান, ‘সওজ কর্মকর্তার মোবাইল পরীক্ষা করে দেখা যায়- তার হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবারে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল ওই নারীর। তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গ ছবিও আদান প্রদান করার দৃশ্য পাওয়া গেছে। চ্যাটিংয়ে বিভিন্ন তরুণীর ছবি দিয়েছিন তার বান্ধবী। যাদের নিয়ে নামিদামি হোটেলে যাওয়ার কথাও সেখানে বলা হয়েছে।’

নানা অপকীর্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোচরে আসার পর সওজ কর্মকর্তা রব্বে একজন মন্ত্রীকে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই কর্মকর্তাকে ফোন করান। কত টাকার বিনিময়ে বিষয়টি সমাধান সম্ভব সেটাও জানতে চেয়েছিলেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই কর্মকর্তা জানান, ‘এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি প্রেমিকাকে যে টাকা দিয়েছিলেন সেটা স্বীকার করে লিখিত দিয়েছেন।’

বিশেষ শাখার আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘তার সঙ্গে অনেক নৈতিক-অনৈতিক সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। যখনই একটা ব্যাংক একাউন্টে সন্দেহাতীত লেনদেন হয়েছে তখন আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। পরে জানা গেছে, সওজের কাজের পারসেন্টেজ হিসেবে এসব টাকা ফজলে রব্বেকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি টাকাগুলো নিজের অনুকূলে না নিয়ে প্রেমিকাকে দিয়েছেন। তার বিষয়ে আমরা আরো খোঁজখবর নিচ্ছি।’

সওজের প্রথম শ্রেণির একজন ঠিকাদার বলেন, ‘ফজলে রব্বে গাজীপুরে থাকাকালে রাস্তার কোনো কাজ টাকা ছাড়া শেষ করা সম্ভব ছিল না। অবৈধভাবে অনেক ঠিকাদারের কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংস্কার কাজে ক্রটি ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে।’

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৯ ১:১৮ অপরাহ্ণ