দেশজনতা অনলাইন : প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রথম দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বিএনপি। এক যুগ পার হয়েছে ক্ষমতায় নেই দলটি। এই অবস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে আশায় বুক বাধলেও আদৌ মুক্তি পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান খোদ নেতাকর্মীরা। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রবাসে। তারও ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অন্যদিকে বারবার আন্দোলনের হুমকি দিলেও তৃণমূলের সংগঠন অনেকটা লেজেগোবরে অবস্থায়। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তারে পর্যদস্ত নেতাকর্মীরা। আবার লম্বা সময় ধরে নতুন নেতৃত্ব না থাকায় গতি হারিয়েছেন তারাও। যদিও দল পূনর্গঠনে কাজ করার কথা জানিয়েছে শীর্ষ নেতারা।
এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠার ৪২বছরে পা দিল দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এর হাল ধরা বেগম খালেদা জিয়াও শারীরিকভাবে অসুস্থ। আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পেলেও সামনের দিনগুলোতে দলে কতটা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তারপরও আমাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। গুম, খুন হয়েছে অনেক নেতা-কর্মী। এরমধ্যেও সংগঠনকে শক্তিশালী করতে অধিকাংশ জেলায় কমিটি দেওয়া হয়েছে। আশা করি দল পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপি একটি শক্তিশালী দলে পরিণত হবে। কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যে চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে, তা মোকাবেলায় আমরা সক্ষম।’
বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও জোটের শরিক ঐক্যফ্রন্টের নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি কবরে যাবে, না জীবিত থাকবে। যেহেতু তাদের দুই নেতার একজন জেলে আর একজন দেশের বাইরে। তাদের এখন স্মরণ করতে হবে জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার যে সাহসের চিত্র ছিল সেটা মনে রাখতে হবে।’
২০ দল থেকে জামায়াতকে বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘জামায়াতকে ছেড়ে দিয়ে ১৯ দল করতে হবে। ১৯ দল আর ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সত্যিকারের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে কোনো ভবিষ্যত নেই। ২১ সাল কেন ৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ছাত্রদলসহ অন্য সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।’
বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, ক্ষমতায় না থাকলেও হতোদ্যম হলে চলবে না। এই সময়ের মধ্যে চেয়ারপারসনের মুক্তি, দল গুছিয়ে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া এবং সপ্তম কাউন্সিল করার পরিকল্পনা করতে হবে।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সামরিক শাসনাধীন দেশে রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালে জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। ১৯৮১ সালে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে হত্যার পর বিপাকে পড়া বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ১৯৯১ সালে। এরশাদের পতনের পর ওই বছর হওয়া নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সে সময় অপ্রত্যাশিতভাবেই নির্বাচনে জিতে আসে দলটি।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জোট করে ভূমিধস জয়ে ক্ষমতায় ফেরে বিএনপি। কিন্তু ২০০৭ সালে আরেকবার একতরফা নির্বাচনের চেষ্টায় থাকা অবস্থায় জারি হয় জরুরি অবস্থা। মূলত তখন থেকেই বিএনপির বিপর্যয়ের শুরু।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালে চরম দুঃসময় নেমে আসে বিএনপিতে। এ সময় দলটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। একটি অংশ সংস্কারপন্থি হিসেবে আর্বিভূত হয়। যদিও খালেদা জিয়ার সুদৃঢ় নেতৃত্ব আর তৃণমূল নেতা-কর্মীদের আস্থায় সংস্থারপন্থীরা হালে পানি পায়নি। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৩০টির কম আসন পায় দলটি।
এর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি নিজ দলের দুই জন জ্যেষ্ঠ নেতার দণ্ড হয়। বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। আর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে গিয়ে ব্যর্থ হয় বিএনপি। বর্জন করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন।
ওই আন্দোলন এবং এক বছর পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সরকার পতন আন্দোলনে নেমে খালি হাতে ফেরার পর বিএনপির দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট হয়। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ ভীষণ চাপে রেখেছে দলটিকে। আর এ থেকে দৃশ্যত বের হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না তারা।
২০১৪ সালে বর্জন করলেও গত ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে গিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ফল করে বিএনপি এবং তার জোট। অথচ এই নির্বাচনের আগে শক্তি বাড়াতে বিএনপি পুরানো মিত্র ছাড়াও কামাল হোসেনের গণফোরাম সহ বেশ কয়েকটি দলকে নিয়ে করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে ভোটের মাঠে কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে পারেনি তারা। নিজেরা এককভাবে সাতটি এবং জোট নিয়ে মাত্র সাতটি আসন পেয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাও হারিয়েছে তারা।
এই নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ তুললেন ভোট শেষে ঘোষিত আন্দোলনেও যেতে পারেনি বিএনপি। এর মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের কার্যক্রমও পুরোপুরি স্থবির। দুই দশকের পুরনো জোটেও চলছে মনোমালিন্য। ২০ দলের ভবিষ্যতও কী হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন জোটের শীর্ষ নেতারা। বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যেই বলছেন, এখন একক শক্তিতে চলার সময় হয়েছে।
বিপর্যস্ত দলটি ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয় বটে, তবে আজও সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। নানা ঝক্কিঝামেলায় থাকা দলটি মেয়াদ শেষ হলেও কবে নাগাদ নতুন কাউন্সিল করতে পারবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতেও পারছে না।
যদিও দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা দাবি করছেন- সারাদেশে দল পুনর্গঠন শেষেই কাউন্সিল করা হবে। তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরকে মাথায় রেখে কাউন্সিল করার চিন্তা চলছে বিএনপিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেন, ‘পরিস্থিতি যাই হোক এর ভেতর থেকেই আমাদের এগুতে হবে। চেয়ারপারসনের মুক্তির লক্ষ্য সবার আগে। কাউন্সিল করতে হবে, সংগঠন গুছিয়ে নিতে হবে। অঙ্গ সংগঠন গতিশীল করতে সঠিক নেতৃত্ব বের করতে হবে। এসবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। কারণ সরকার সবকিছু নির্বিঘ্নে করতে দেবে এটা ভাবার সুযোগ নেই। ’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘিরে আয়োজন
এদিকে ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে দলটি। ঢাকাসহ সারাদেশে পালিত হবে এসব কর্মসূচি।
আজ রবিবার সকালে বিএনপি মহাসচিব দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। বিকালে বিএনপির উদ্যোগে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আলোচনা সভা হবে। সারাদেশেও একইভাবে কর্মসূচি পালিত হবে।