দেশজনতা অনলাইন : ঈদে ছুটি পাননি মনিরুল ইসলাম মনি। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের রিপোর্টার। বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা। সবাই যখন ফিরতি পথে তখন তিনি বাড়ির পথে। কিন্তু বাসের টিকিট কাটেননি। দুই চাকার মোটরসাইকেলে ভরসা করেন।
এই যাত্রাটি বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারত। ঢাকা পেরিয়ে আশুলিয়া পৌঁছাতেই তার মোটরসাইকেলটি সড়কে পিছলে নিয়ন্ত্রণ হারায়। বলতে গেলে ভাগ্যের জোরেই বেঁচে যান মনি।
এই সংবাদকর্মী বলেন, ‘আজ যদি পেছনে অন্য কোনো গাড়ি থাকত, তাহলে আমার আর বাঁচার সুযোগ ছিল না। এইবারই শেষ। আর কখনো মোটরসাইকেলে বাড়ি যাব না।’
আরেক সংবাদকর্মী তৌহিদুজ্জামান তন্ময় সময় বাঁচাতে ঈদের আগে বাড়ি গেছেন মোটরসাইকেলে চেপে। তার বাড়িও কুষ্টিয়ায়। ফিরে এসেছেন নিরাপদেই। তবে যাত্রাপথে নানা অভিজ্ঞতা আর সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যাত্রীকল্যাণ সমিতির একটি পরিসংখ্যান দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই কাজ আর করবেন না কখনো। পথে দেরি হলেও বাড়ি যাবেন বাসে বা অন্য গাড়িতে করে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যালোচনা করে যাত্রীকল্যাণ সমিতি যে হিসাব দিচ্ছে, সেটি রীতিমতো গা শিউরে উঠার মতো। ঈদে বাড়ি যাওয়া এবং ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ নিহত হয়েছে, তার এক তৃতীয়াংশই মোটরসাইকেলের যাত্রী।
আরও একটি পরিসংখ্যান বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আরোহীদের মধ্যে বাঁচতে পেরেছেন খুবই কম।
কুষ্টিয়া ঘুরে আসা তন্ময় বলেন, ‘রাস্তায় যানজট থাকে, তাই সময় বাঁচাতে মোটরসাইকেলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আমি আর কখনো মোটরসাইকেলে বাড়িতে যাব না। বাসেই যাব।’
যাত্রীকল্যাণ সমিতি জানাচ্ছে, গতকাল বাদ দিয়ে ঈদযাত্রা এবং ফিরতি পথে সড়কে ঝড়েছে ২২৪ জনের প্রাণ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের যাত্রী ৭৭ জন। অর্থাৎ নিহতদের ৩৪.৩৭ শতাংশই মোটরসাইকেল আরোহী।
এবার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমেছে। তবে যে সংখ্যাটি এবার পাওয়া গেছে সেটি আরো কম হতে পারত, যদি না মোটর সাইকেলে করে বাড়ি যাওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা না থাকত।
২০১৮ সালে ঈদ যাত্রা এবং ফিরতি পথে নিহতদের মধ্যে ১৫.২৮ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেলের যাত্রী। এবার এই সংখ্যাটি হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান এবং গতকালের দুর্ঘটনার হিসাব করলে দেখা যায়, মোটরসাইকেলের পর সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে অটোরিকশায়। এই হারটি ২০ শতাংশের আশপাশে। এ ছাড়া মহাসড়কে অবৈধভাবে চলা ধীর গতির নসিমন, করিমন বা এই ধরনের বিপজ্জনক যানবাহন বিপুল সংখ্যক প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
প্রতিটি দুর্ঘটনায় এক বা দুজন নিহত হয় বলে গণমাধ্যমে এসব খবর সেভাবে শিরোনাম হয়ে আসে না। ফলে মোটরসাইকেলের বিপত্তি নিয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে।
আবার বিপুল পরিমাণ মৃত্যু হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা পুলিশ মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো নিয়ে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি।
যানজট এগিয়ে দ্রুত যাওয়া যায় বলে মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। প্রতি বছর বিক্রি বাড়ছে লক্ষাধিক বাহনের। প্রধানত স্বল্প দূরত্বের এসব বাহন ইদানীং দূর পাল্লাতেও ব্যবহার হচ্ছে। এই ঝুঁকি বেশি নিচ্ছে তরুণরাই। তবে মহাসড়কে এসব গাড়ির জন্য আলাদা নিরাপদ লেন না থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে সেগুলো। উল্টো দিক থেকে আসা যানবাহনের সঙ্গে ধাক্কা বা পেছন থেকে আসা দ্রুতগামী গাড়ি চাপা দিলে আরোহীদের বাঁচার সম্ভাবনা থাকে কম।
আরোহীরা বড় শহরে স্বল্প দূরত্বের পথে বাইক চালাতে অভ্যস্ত। দূরের পথের যাত্রার অনভ্যস্ততা আর মহাসড়কের বিভিন্ন মোড়ের পরিস্থিতি না জানা থাকা দুর্ঘটনার একটি কারণ।
এ ছাড়া বৃষ্টিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল হয়ে পড়লে চাকা পিছলে প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারায় আরোহীরা। আর এই সময় পেছন থেকে বা উল্টো পাশ থেকে দ্রুতগামী কোনো গাড়ি আসলে তাতে চাপা পড়লে জীবন শঙ্কায় থাকেন আরোহীরা। কিন্তু ঈদের আগে টিকিট জোগাড় করতে ভোগান্তি বা যানজটের কথা চিন্তা করে বহু জন এই ঝুঁকি নিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘মোটরসাইকেল যারা চালায় তাদের একটা বিষয় থাকে না, তাদের প্রশিক্ষণ থাকে না। তাদের মধ্যে একটা চার্মিং ভাব থাকে। তাদের অনেকেরই বয়স কম থাকে। দ্রুত চলার একটা প্রবণতা থাকে। যেহেতু মোটরসাইকেলটা দুই চাকার উপর চলে তাই দুর্ঘটনাও ঘটে।’
মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাটা কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি যেহেতু বাহন, তাই অনেকে যেতে পারে। দেশের বাইরে আপনি দেখবেন তারা মোটরসাইকেল নিয়ে দূরে কোথাও গেলে আলাদা একটা পোশাক পরে। আমাদের দেশেও সেটা করা উচিত। আর এ জন্য অনেক প্রচার প্রচারণা করতে হবে। সচেতনতা প্রয়োজন।