দেশজনতা অনলাইন : ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে চমকের সাংবাদিকতা বিভ্রান্তির আরেক কারণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী। গতকাল ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে এই মন্তব্য করেন তিনি।
মঙ্গলবার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল ঢাকায় একটি সেমিনারে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। এই মশাগুলো কীভাবে কোথায় বংশ বিস্তার করে, তার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
নাগপাল জানান, মশাগুলো প্রধানত ঘরোয়া পরিবেশে এবং বাইরের বিভিন্ন স্থানে ডিম পারে। কিন্তু ফগার মেশিন দিয়ে মশা নিধনের যে কার্যক্রম, তাতে ওই প্রজননস্থলগুলোতে কিছু হয় না।
নাগপাল আরও জানান, মশাগুলো খুবই বুদ্ধিমান। তারা এমন জায়গায় ডিম পারে, যেখানে পরে পানি জমতে পারে এবং এই পানিতেই ডিমগুলো ফুটে বাচ্চা বের হয়।
নাগপালের বক্তব্য ছিল এমন: ‘এ মশা চালাক। একটি নারী এডিস মশা পাত্রের কানায় ডিম দেয়। আদর্শ পরিবেশে ডিমগুলো এক বছরের অধিক সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। যখন বন্যা হয় বা পাত্রটি পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে তখন দ্রুত ডিম ফুটে যায়। মশার বাচ্চা বা শুককীট ফুটতে সর্বনিম্ন দুই মিলিলিটার পানিই যথেষ্ট।’
ফগার মেশিনে রাস্তা বা উন্মুক্ত জায়গায় কীটনাশক ছিটিয়ে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা মারার আশা কেবলই মিথ বলেও মনে করেন ড. নাগপাল। সেজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে নিজের ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সকাল-সন্ধ্যা অ্যারোসল স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে এমন শিরোনামে যে, ‘এডিস মশা পানিতে ডিম পারে না।’
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী সাইদুর রহমান চৌধুরী মনে করেন, এই ধরনের শিরোনাম করা হয়েছে ‘চমক’ তৈরির জন্য। কিন্তু এতে বিভ্রান্তির তৈরি হবে।
নিজের ফেসবুক পেজে এই বিজ্ঞানী লিখেন, ‘যারা বেশি পড়তে চান না, তাদের জন্য সহজ উপায় দিচ্ছি। images.google.com এ যান। সার্চ বক্সে লিখুন aedes aegypti life cycle, ছবিগুলো দেখুন। সব ছবিই বিশ্বাসযোগ্য উৎস্য থেকে আসা তা নয়। কিন্তু অনেক ছবিই বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট বা সমগোত্রীয় বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে আসা।’
‘অনেক ছবিতেই দেখবেন মশার ডিমগুলো ফুটে বাচ্চা (লার্ভা) বের হচ্ছে পানিতে, তাদের বিকাশ হচ্ছে পানিতে- পানি ছাড়া এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব। মানে অসম্ভব।’
নাগপালের বক্তব্য নিয়ে সাইদুর বলেন, ‘তাহলে এই বিশেষজ্ঞ কেন বলছেন, এটি ভুল তথ্য? আসলে তিনি এমন বলেছেন বলে আমি মোটেও মনে করি না। তিনি বলেছেন, মশা পানির পাত্রের কিনারায় ডিম পাড়ে। পানির সংস্পর্শে এসে তা ফুটে। আর আমাদের উর্বর মস্তিষ্কের সংবাদ পরিবেশনকারীরা তাদের সহজাত ক্যাচি টাইটেল বানাবার জন্য লিখতে শুরু করেছে ‘অ্যাডিস মশা পানিতে ডিম পাড়ে না: জানালেন বিশেষজ্ঞ’।
‘এতে করে জনমনে বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ রয়ে যাচ্ছে। বন্ধ হোক বিভ্রান্তিজনক সংবাদ পরিবেশন।’
জুন মাসের শুরু থেকে ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়। আস্তে আস্তে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে, যার বিস্তৃতি ঢাকা ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বেসরকারি হিসেবে ইতোমধ্যে মশাবাহিত এই রোগে সত্তর জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন হাজারো মানুষ। ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহতার মধ্যে সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমে শিথিলতার অভিযোগ ওঠে। মশা মারার কার্যকর ওষুধ কেন কেনা হল না- সেই প্রশ্ন জোরালো হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতিতে হাতে থাকা ওষুধের ডোজ আর ফগার মেশিন বাড়িয়ে রাস্তাঘাটে ছিটিয়ে মানুষের আতঙ্ক কমানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় দুই সিটি করপোরেশনকে। দুই মেয়রের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রিদেরও ফগার মেশিন হাতে রাস্তায় নামতে দেখা যায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে। কিন্তু এতে কোনো কাজ তো হচ্ছেই না, উল্টো প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ঢাকা বা বড় শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও পৌঁছে গেছে এই রোগ।