এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, যেসব জেলা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে, সেগুলো হলো—ঢাকা বিভাগের ঢাকা, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ি, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ; চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি; খুলনা বিভাগের খুলনা জেলা, কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা; রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলা, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর; রংপুর বিভাগের রংপুর জেলা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও, বরিশাল বিভাগের বরিশাল জেলা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি এবং সিলেট জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ১৪ জন এখনও চিকিৎসাধীন। এ প্রসঙ্গে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ভর্তি থাকা রোগীদের সবাই ঢাকা থেকে ফেরত আসার পর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।’
যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহ ধরে একজন, দুজন করে জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি শুরু হয়। গতকালও একজন ভর্তি হয়েছেন। পরীক্ষায় তাদের শরীরে ডেঙ্গুর জীবাণু পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত মোট ১৯ জনকে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৫ জন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। অন্যদের চিকিৎসা চলছে।
আক্রান্তরা জানিয়েছেন, তারা বিভিন্ন কাজে ঢাকায় ছিলেন। ঢাকা থেকে ফেরার পরই তারা জ্বরে আক্রান্ত হন। একই কথা জানিয়েছেন যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদও। তিনি জানান, যশোরে ডেঙ্গু রোগের জীবাণু নেই। কেবল ঢাকা ফেরতরাই আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু মূলত রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও এবার ঢাকার বাইরেও আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এক হাজার ২৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৫৩১ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনেই কোরবানির ঈদ। এই ঈদে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষ পরিবার-স্বজনের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে যায়। ঈদের সময়ে গ্রামের বাড়িতে গেলে এই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কারণ, যেকোনও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সুস্থ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তারা গ্রামে যাওয়ার পর সে মানুষকে যদি কোনও মশা কামড় দেয় এবং তারপর যদি সে মশা আরেকজন সুস্থ মানুষকে কামড় দেয়, তাহলে সে মানুষটিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবেন।’
অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ঢাকার বাইরে যেসব ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এরা ঢাকায়ই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার পর পরীক্ষা করাতে গিয়ে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।’ তাই ঈদের সময়ে অন্তত যারা জ্বরে আক্রান্ত থাকবেন তাদের গ্রামের বাড়ি না যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
ডেঙ্গু রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ঢাকাসহ বড় বড় শহরের হাসপাতালগুলোয় যেভাবে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক থাকেন, সেভাবে গ্রামের হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক পাওয়া যাবে না। তাই এ সময় যেকোনও দুর্ঘটনার আশঙ্কাও অনেক বেশি বেড়ে যাবে।’
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার খান বলেন, ‘আমরা অফিসিয়ালি ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ঈদের সময়ে ঢাকা না ছাড়ার জন্য অনুরোধ করছি। কারণ, চট্টগ্রামে যত রোগী আমরা পেয়েছি, তার ৮০ শতাংশেরই গত এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকায় যাতায়াত করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার যত বাস কাউন্টার রয়েছে, বিশেষ করে ছোট ছোট কাউন্টার, সেসব জায়গায়ও কিন্তু এডিস মশার জন্ম হতে পারে। ঈদের সময়ে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে অপেক্ষা করবে। তাই অনুরোধ থাকবে যেন কোনও রোগী ঢাকার বাইরে না যান।’
মৌলভীবাজারে কর্মরত ডা. শাব্বির হোসেন খান বলেন, ‘মৌলভীবাজারে ১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে আট জনের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, ডেঙ্গু ধরা পড়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা ঢাকা ট্রাভেল করেছেন। তাই আসছে ঈদের সময়ে নিজের নিরাপত্তায়, পরিবারের অন্যদের নিরাপত্তায় অন্তত এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তদের গ্রামের বাড়ি না যাওয়ার পরামর্শ তার।’
এদিকে, ঈদের সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তরা গ্রামে গেলে সেখানেও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) -এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘এডিস এজিপ্টি মশা ঢাকায় ডেঙ্গুর বাহক হলেও ঢাকার বাইরে এডিস অ্যালবোপিকটাস মশার মাধ্যমেও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে।’ আর এই এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা ঢাকার বাইরের এলাকায় রয়েছে বলেও তিনি জানান।