সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি বড় অংশই পথচারী। ধারণা করা হয়, তারাও রাস্তা পারাপারে অসতর্ক থাকে বলেই ঘটছে অজস্র দুর্ঘটনা। একই পরিস্থিতি রেলেও। কিন্তু সেখানে সড়কের মতো লাইনে সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা থাকে না। মাঝেমধ্যে আসে ট্রেন। কিন্তু তাতেই কাটা পড়ছে অজস্র মানুষ।
২০১৮ সালের হিসাবটি এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি রেলওয়ে পুলিশ। তবে আগের বছর রেলে কাটা পড়ে দুই হাজার ১০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
পাঁচ বছরের হিসাবটি আরও ভয়াবহ। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারাদেশে চার হাজার ৬১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রতি বছর এই সংখ্যাটি বাড়ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছর সারা দেশে সাত হাজার ২২১ জন মানুষ মারা গেছে সড়কে। এই দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা চলে বছর জুড়েই। অথচ এর তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ যে মারা যাচ্ছে রেলে, এ নিয়ে কারো যেন ভাবান্তর নেই। পথচারীদের সতর্ক বা সচেতন করতে রেল কর্তৃপক্ষেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
ঢাকা রেলওয়ে থানার রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুশো বণিক বলেন, ‘রেলে কাটা পড়া মানুষের বেশিরভাগই দেখবেন অসবাধনতায় পারাপার সময় কিংবা হেডফোন কানে লাগিয়ে হাঁটার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তাদেরকে সতর্ক করার ব্যবস্থা না নিলে দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে।’
‘এখন তো রেললাইন ঘেঁষে মানুষ বাড়ি তৈরি করছে সেখানে নিজেদের ইচ্ছেমতো রেললাইনে পারাপারে ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু রেলওয়ে আইন এগুলো অনুমোদন করে না। এসব বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দিতে হবে।’
রেল আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কেউ এমনকি গবাদিপশুরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করা যায়। তবে বাস্তবতার কারণেই কাউকে এ জন্য আটকের উদাহরণ নেই।
রেলওয়ের পরিচালক (প্রকৌশলী) গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে রেললাইনের আশপাশে সাধারণত কিছু থাকে না। আর আমাদের এখানে হয়েছে উল্টো। বরং রেল লাইনের উপরে কাঁচাবাজার পর্যন্ত বসে গেছে। তবে এসব বিষয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত আসছে।’
রেল লাইন হেঁটে পার হওয়ার পাশাপাশি গাড়িগুলোও রেললাইন অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়। গত সোমবার ট্রেন আসার সময় একটি মাইক্রোবাস চালকের অসতর্কতায় নববধূ ও তার স্বামীসহ প্রাণ গেছে ১১ জনের। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
একই দিন রাজধানীর খিলক্ষেত রেল ক্রসিংয়ে ট্রেন আসছে দেখেও দৌড়ে পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন একজন নারী। কিন্তু ট্রেনের গতির সঙ্গে পেরে উঠেননি। ওই নারীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ট্রেনটি, আর তার গায়ের মাংস খুবলে খুবলে পড়তে থাকে। বীভৎস এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেননি প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পুলিশের হিসাব বলছে, সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু আবার হয় ঢাকায়। বছরে নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেল লাইনে মারা যায় বছরে প্রায় তিনশ জন। এদের বেশিরভাগই লাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য ট্রেনের ছাড় থেকে পিছলে কাটা পড়ে মারা গেছেন।
ঢাকা রেলওয়ে থানার তথ্যমতে চলতি বছরে জুলাইয়ে রেল লাইনে প্রাণ গেছে ১৫৫ জনের। আর ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১০ বছরে এই সংখ্যাটি ছিল দুই হাজার ৭৭৯ জন। এর বিপরীতের রেলওয়ে থানায় মামলা হয়েছে দুই হাজার ৬৭১টি।
যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি (১১৭৩) জন মারা গেছেন রেল লাইন পার হওয়ার সময়। আর একটি বড় অংশের কানে ছিল হেডফোন। মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় বা গান শোনার সময় ধাবমান ট্রেনের শব্দ তারা শুনতে পারেননি। ১০ বছরে এভাবে মারা গেছেন ৪৬৭ জন।
রেলের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রয়োজনীয় গেটকিপার ও অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিংয়েয়র কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। তবে পথচারীদের নিজেদের জীবন নিয়ে সতর্ক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অবকাঠামোর পাশাপাশি এই দিকে মনোযোগ না দিলে প্রাণহানি বাড়তেই থাকবে।
ঢাকার রেলওয়ে থানার তথ্য অনুসারে টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রুটে ২০১০ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান ২০৩ জন। পরের বছর তা বেড়ে হয় ২৫৬ জন। ২০১২ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৩০৬ জন; পরের বছর ৩১৮।
২০১৪ সালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০৫। এর পরের তিন বছর তা ছিল যথাক্রমে ২৮৫, ৩০৫ ও ২৮২ জন। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালে, ওই বছর প্রাণ হারায় ৩৪৬ জন।
ট্রেনে কাটা পড়ে নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই পুরুষ। ঢাকায় গত ১০ বছরে নিহত দুই হাজার ৭৭৯ জনের মধ্যে দুই হাজার ১৪৮ জন পুরুষ, নারী ৪৬৮ জন।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর যতগুলো খবর আসে তার কারণ অসাবধানতা ও অসচেতনতা। এ বিষয়ে রেলওয়েরও কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তার মধ্যে যেসব স্থানে গেটকিপার নেই সেখানে গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া। রেলওয়ের সংলগ্ন বস্তিগুলোকেও স্থানান্তর করা উচিত।’