শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালেরও এটি প্রথম বাজেট।
গত ১৩ জুন অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য মোট ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন। যদিও তিনি অসুস্থতার কারণে পুরো বাজেট উপস্থাপন করতে পারেননি। বাজেট বক্তৃতার বাকি অংশ সংসদে উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এবার বাজেটের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটের এডিপিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগকে। এডিপিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, ২৯ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ, ২৬ হাজার ১৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২৫ হাজার ১৬৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে এবারের বাজেটে করের হার না বাড়িয়ে এর আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের কৌশল দেখানো হয়েছে। করদাতার সংখ্যা ২০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১ কোটিতে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে বাজেটে।
বাজেটে শিক্ষা খাতের সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কার, শেয়ারবাজারে সুশাসন ও প্রণোদনা বিষয়ে সংস্কারমূলক দিকনির্দেশনা রয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসৃজন ও মানব সম্পদকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবারের বাজেট। ২০২০ সালে পালিত হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হবে ২০২১ সালে। এ কারণেই ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি হবে সব দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি জাতির এই বড় দুটি অর্জন উপলক্ষে সরকারের নানা পরিকল্পনা বা প্রতিশ্রুতিও রয়েছে নতুন বাজেটে।
এবারের বাজেটে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের তিন কোটি শতভাগ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। এটি করতে পারলে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ১৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে সরকার আশা করছে। এমন ঘোষণাও রয়েছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। সে লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তার প্রসার ঘটানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা।
বাজেট উপস্থাপনের পরদিন গত ১৪ জুন শুক্রবার বেলা ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের কার্নিভাল হলে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এবারই এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় প্রধানমন্ত্রী দলের সিনিয়র কয়কজন মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নিজে এ সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। নতুন বাজেটে ভ্যাট আইন কার্যকর করতে ভ্যাটের একটি স্তর ভেঙে ক্রেতার সুবিধার্থে ৬ স্তরের ভ্যাট কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকেই কার্যকর করা হবে ভ্যাট আইন।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছর রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে করবহির্ভূত আয় ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৭১০ কোটি টাকা। নতুন বছর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। বৈদেশিক সহায়তা বাবদ ঋণ নেওয়া হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে নেওয়া হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়ানো হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকা ১৪ শ্রেণির জনগোষ্ঠীর পরিধি। এবার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কার্যক্রম, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম, লিভার সিরোসিস, ক্যানসার, কিডনি, স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহায়তা, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, গ্রামীণ দুস্থ মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী মায়েদের সহায়তা তহবিল ও ভিজিডি কার্যক্রম বেড়েছে।
এই বেষ্টনীতে নতুনভাবে আরও ১৩ লাখ মানুষকে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বেষ্টনীর আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৭ লাখ।