২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৪৮

বাজারে পাস্তুরিত দুধ : বিএসটিআই না ঢাবির রিসার্চ, কোনটা ঠিক?

দেশজনতা অনলাইন : বাজারে প্রচলিত পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত তরল দুধের মান নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। একই দিনে দুটি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে ভিন্ন তথ্য। তাতে দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশে পণ্যমান নির্ধারণের সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বাজারে প্রচলিত ১৪ ব্র্যান্ডের ১৮টি পাস্তুরিত দুধের নমুনা পরীক্ষা করে আশঙ্কাজনক কোনো কিছু পায়নি।  আর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি বিভাগ তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, অন্তত সাতটি দুগ্ধপণ্যে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছে তারা।

বিএসটিআই তাদের প্রতিবেদন মঙ্গলবার আদালতে জমা দেয়। আর ঢাবির বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি বিভাগ একই দিন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সাতটি দুগ্ধ পণ্য ছাড়াও তারা গুঁড়া মশলা, তেল (সয়াবিন, সরিষা, পাম অয়েল), ঘি, ফ্রুটড্রিংকস নিয়েও গবেষণা প্রকাশ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট ও ইগলু ম্যাংগো মানহীন বলে জানিয়েছে। এসব দুধে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম এবং কিছু দুধে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব মিলেছে গবেষণায়। এসব প্রতিষ্ঠানের কৌটাজাত ঘিয়েও মান কম পাওয়া গেছে।

আদালতে জমা দেওয়া বিএসটিআইয়ের প্রতিবেদনে যে ১৮টি পণ্যে ক্ষতিকারক কিছু নেই বলা হয়েছে, এর মধ্যে এই সাতটি পণ্য রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের ফার্মেসি লেকচার থিয়েটারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ।

হাইকোর্টে বিএসটিআইয়ের প্রতিবেদন

গতকাল নির্ধারিত দিনে বিএসটিআই পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষার প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। প্রতিবেদনে ১৪ ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে আশঙ্কাজনক কিছু নেই বলে জানানো হয়। ব্র্যান্ডগুলো হলো- পুরা, আয়রান, আড়ং ডেইরি, ফার্ম ফ্রেশ মিল্ক, মো, মিল্ক ভিটা, আফতাব, আল্ট্রা, তানিয়া (২০০ গ্রাম ও ৫০০ গ্রাম), ইগলু, প্রাণ মিল্ক, ডেইরি ফ্রেশ, মিল্ক ফ্রেশ এবং কাউহেড পিওর মিল্ক।

বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি দাখিলের পর আদালত এ মামলার পরবর্তী কার্যক্রম আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করে।

২০১৮ সালের ১৭ মে ‘পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশই নিরাপদ নয়’ শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনগুলো নজরে আনা হলে আদালত এ বিষয়ে রিট আবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়।  ২০ মে হাইকোর্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ।

ওই রিটের শুনানি নিয়ে বাজারে পাওয়া যায় এমন সব ব্রান্ডের পাস্তুরিত দুধের মান পরীক্ষা করে প্রতিবেদন জমা দিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিকে নির্দেশনা দেয় আদালত।

আমরা থাকব না মরে যাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তাদের গবেষণার জন্য পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়- মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, প্রাণ, ইগলু, ইগলু চকোলেট ও ইগলু ম্যাংগো। আর অপাস্তুরিত দুধের তিনটি নমুনা সংগ্রহ করা হয় রাজধানীর পলাশী, গাবতলী ও মোহাম্মদপুর বাজার থেকে।

সংবাদ সম্মেলনে ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘আমরা যে ফলাফল দিয়েছি তা নমুনার ফলাফল। তার মানে এই না যে ওই সব কোম্পানির সব পণ্যই এ রকম। আমরা কিন্তু থাকব না, মরে যাব, যদি এভাবে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক যে গরুকে খাওয়ানো হলো ওই গরুর দুধ ও মাংস আমরা খেলে তা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।’ মানুষ বাঁচাতে এখনই গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো বন্ধ করার তাগিদ দেন তিনি।

এসব দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগের উল্লেখ করে আ ব ম ফারুক বলেন, ‘আমাদের পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলোতেই মানবচিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অপাস্তুরিত দুধের একটি নমুনাতে ফরমালিনও মিলেছে। অন্য একটিতে পাওয়া গেছে ডিটারজেন্ট।’

এ ছাড়া বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দুধে ফ্যাট ইন মিল্ক থাকতে হবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। বিশ্লেষণে পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার মধ্যে ছয়টিতেই এই পরিমাণে ফ্যাট ইন মিল্ক ছিল না। সলিড নট ফ্যাট থাকতে হবে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু বিশ্লেষণে এসব দুধের সবগুলোতেই কম ছিল।

আর টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্টও ছিল পাস্তুরিত দুধের সবগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। কলিফর্ম কাউন্ট পাস্তুরিত দুধের দুটি নমুনাতে ছিল অনেক বেশি। আর স্টেফাইলোকক্কাস স্পেসিজ শূন্য থাকার কথা থাকলেও পাস্তুরিত দুধের পাঁচটিতে এর জীবাণুর উপস্থিতি তো ছিলই, এমনকি এর পরিমাণও ছিল অনেক বেশি। অর্থাৎ, বিএসটিআই মানদ- এসব দুধের সবগুলোই বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।

ম্যাংগো ড্রিংকস নিরাপদ নয়

ফ্রুট ড্রিংকসের মধ্যে স্টারশিপ ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, সেজান ম্যাংগো ড্রিংক, প্রাণ ফ্রুটো, অরেনজি, প্রাণ জুনিয়র ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, লিটল ফ্রুটিকা ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, সানড্রপ, চাবা রেড অ্যাপল, সানভাইটাল নেকটার ডি ম্যাংগো, লোটে সুইডেন্ড অ্যাপল ড্রিংক ও ট্রপিকানা টুইস্টার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী কৃত্রিম মিষ্টিকারক সাইক্লামেট ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ১১টি পণ্যের সবগুলোতেই এর ব্যবহার ছিল অতিমাত্রায়।

সয়াবিন তেলেও ঝামেলা

সয়াবিন তেলের মধ্যে রূপচাঁদা, ফ্রেশ, পুষ্টি, তীর, এসিআই পিওর, ভিওলা, মুসকান ও মিজান-এর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী তেলের অ্যাসিড ভ্যালু, স্যাপনিফিকেশন ভ্যালু, পারক্সাইড ভ্যালু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আয়োডিন ভ্যালু আটটি নমুনার চারটিতে কম ও একটিতে বেশি পাওয়া গেছে। জলীয় উপাদান আটটি নমুনাতেই স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।

টিনের ঘিয়ে ভেজাল

বাজারে প্রচলিত ৮টি ঘিয়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। এগুলো হলো- বাঘাবাড়ি, প্রাণ, মিল্কভিটা, মিল্কম্যান, সমির ও টিনে বিক্রি হওয়া নামবিহীন দুটি নমুনা। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ঘিয়ে জলীয় উপাদান ও আয়োডিন ভ্যালু যতটুকু থাকার কথা, এসব নমুনায় তার থেকে বেশি পাওয়া গেছে। আর তিলের তেলের কোনো উপস্থিতি থাকতে পারবে না উল্লেখ থাকলেও এসব পণ্যের সবগুলোতেই এর উপস্থিতি ছিল। এ বিবেচনায় আটটি নমুনাই মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।

আমরা কী খাব?

সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাও মানহীন দুধ বিক্রি করছে- সে ক্ষেত্রে মানুষ কী খাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে  ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমারও একই প্রশ্ন, আমরা কী খাব? কিন্তু এই প্রশ্ন কার কাছে করব। সত্য কথা হলো অসাধু বাণিজ্য যার হাতে পড়বে, তারা এমনটা করবেই। সে সরকারি হোক, কি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এর থেকে উত্তরণে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে মানহীন পণ্যই মানুষ কিনে খেতে বাধ্য হবে।’

আ ব ম ফারুক বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে কিছুদিন পরে ফলাফল তুলে ধরি। কিন্তু যারা নীতিনির্ধারণী আছেন তারা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে পারেন।’

প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মেহেদী মাসুদ বলেন, ‘আমাদের ডিপার্টমেন্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে শুনেছি। তবে এটা নিয়ে আমি বিস্তারিত জানি না। তাই ধারণার ওপর কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্ট ক্লেইম করেছে, সে ক্ষেত্রে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারি।’

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সব সময় কিছু না কিছু ঝামেলা থাকেই উল্লেখ করে অধ্যাপক মেহেদী মাসুদ বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কথা বলা ডিফিকাল্ট (কঠিন)। তবে এখানে প্রশ্ন হলো বিএসটিআই বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোর ঠিকমতো তদারকি হচ্ছে কি না।’

প্রকাশ :জুন ২৬, ২০১৯ ১:২২ অপরাহ্ণ