দেশজনতা অনলাইন : নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে যেসব সংস্থা কাজ করছে তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার তথ্য পাওয়া গেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রীতিমতো বিরক্ত। তাদের কথা অন্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থা শুনছে না বলে জানিয়েছেন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এর পাশাপাশি আছে সুযোগ-সুবিধার অভাব। যে কারণে তারা তাদের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না।
আবার কথা শুনতে বাধ্য করবে, এমন ক্ষমতাও নেই কর্তৃপক্ষের। মৌসুমি ফল নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত যে অভিযান চালাচ্ছে, তার সঙ্গে একমত নয় এই সংস্থাটি। কিন্তু তারা তা ঠেকাতে পারছে না।
গত কয়েক বছর ধরে কৃত্রিমভাবে ফল পাকানো নিয়ে তোলপার দেশে। ইথোফেন নামে একটি হরমোন দিয়ে ফল পাকানোয় হাজার হাজার মণ আম ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু এই হরমোন অনিরাপদ বা ক্ষতিকর নয়। এই বিষয়টি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে গত বছরই। কিন্তু এ বছরও বিশেষ করে বাজারে আম নিয়ে এই অভিযান বন্ধ হচ্ছে না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর নিরাপদ খাদ্য আইন পাস হয়। এর অধীনে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি গঠন হয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তারা ছাড়াও ভোক্তা অধিকার এবং নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করে বিএসটিআই এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য আদালতসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। তবে এদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সবগুলো সংস্থা একসঙ্গে কাজ না করে যে যার মতো কাজ করে। ফলে খাদ্যে ভেজাল মোকাবেলা আর নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কাজটি আগাচ্ছে না সেভাবে। কারণ, একটি নীতিমালা অনুযায়ী সবাই কাজ করছে না।
এমনও দেখা গেছে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কিছু খাবার হোটেলকে তাদের মান অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নিরাপদ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এসেছে। কিন্তু পর দিনই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এগুলোকে না মেনে জরিমানা করে এসেছে। এ নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে টানাপড়েনও তৈরি হয়েছিল।
সম্প্রতি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ৫২ ধরনের পণ্যে ভেজাল পেয়েছে বিএসটিআই। হাইকোর্টে এই প্রতিবেদন জমা পড়ার পর পণ্যগুলো বাজার থেকে তুলে নেয়ার নির্দেশ আসে। আর সে নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ উচ্চ আদালত নিরাপদ খাদ্য সংস্থাকে নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায়। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে এই পদ ছেড়ে ব্যাংকের কেরানির পদ নেওয়ার কথাও বলে উচ্চ আদালত। প্রাণ-এসিআইয়ের মতো কোম্পানিকে সংস্থা ভয় পায় কি না, এ প্রশ্নও তোলেন বিচারপতি।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মাহবুব কবির বলছেন, তাদের হাত-পা বাঁধা। তাদের কথা অন্য সংস্থা শোনে না। আবার তারা যেসব নির্দেশনা দেন, সেগুলো কার্যকরের ক্ষমতা তাদের নেই। তাকিয়ে থাকতে হয় অন্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থার ওপর। কিন্তু তারা আবার নানা সময় এই নির্দেশনা মানতে চায় না।
মাহবুব কবির বলেন, ‘অন্যান্য দেশে নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর সবার ওপরে থাকে। আর আমাদের কারও না কারও আওতায় থাকতে হয়। এভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। অবশ্যই স্বাধীনতার দরকার।’
অবকাঠামোগত ও লোকবলের স্বল্পতাও ভোগাচ্ছে সংস্থাকে। তাদের নিজস্ব গবেষণাগার নেই। কর্মচারী কর্মকর্তা যে কয়জন আছেন, তাদের পক্ষে এত বড় একটি খাতে তদারকি করা কঠিন।
মাহবুব কবির বলেন, ‘আমরা ১২ জন লোক আছি। এত অল্প লোক, সেটা পরের বিষয়। কিন্তু এই লোকেরাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরকে আলাদা করতে হবে। দুদকের মতো স্বাধীন করে দিতে হবে। আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার।’
কারও সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না বলেও আক্ষেপ রয়েছে এই কর্মকর্তার। বলেন, তারা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন। অথচ মন্ত্রণালয়ের কোনো অধিদপ্তরই তাদের সাহায্য করছে না।
অথচ সব দায় এখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে নিতে হচ্ছে। মাহবুব কবির বলেন, ‘মাছ, মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে। এই খাত নিয়ে যারা কাজ করবে, তারা কিন্তু আমাদের অধীনে নয়। আমরা পর্যাপ্ত সভা করেছি এসব বিষয় নিয়ে। বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় কিংবা সংশ্লিষ্টরা তা মানছে না।’
এভাবে চলতে থাকলে নিরাপদ খাদ্য থেকে ফলপ্রস্যূ কোনো কিছু আশা করা কঠিন বলে এই কর্মকর্তা বলেন। বলেন, ‘আমাদের লোকবল আর ক্ষমতা দিতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার লাগবে।’
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান এই পরিস্থিতিতে দুঃখজনক বলেছেন। তিনি বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সৃষ্টিই করা হয়েছে এ নিয়ে কাজ করা সবগুলো সংস্থার সমন্বয় করার জন্য। যদি অন্য মন্ত্রণালয়গুলো এই সংস্থার কথা না শোনে, তাহলে তারা যেন তাদের নিয়ন্ত্রক খাদ্য মন্ত্রণালয়কে অভিযোগ করে। তারাই অন্যদের সঙ্গে কথা বলে এর সমাধান করুক।
খাদ্যে ভেজাল নিয়ে যেহেতু দেশবাসীর মধ্যে উদ্বেগ আছে, সেহেতু সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও এ বিষয়ে কাজ করা দরকার বলেও মনে করেন ক্যাব সভাপতি।