একই পরিস্থিতি হলুদ, মরিচসহ মোড়কজাত সব গুঁড়া মশলার ক্ষেত্রে। এক কেজি আস্ত হলুদের দাম কেজিপ্রতি বড়জোড় ১২০ টাকা। অথচ গুঁড়া অবস্থায় এই মশলা কিনতে হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে।
এত বিপুল পরিমাণ মুনাফার পরেও যদি ভোক্তারা মানসম্পন্ন পণ্য পেত তাও এক ধরনের সান্ত¡না ছিল। তবে মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের গবেষণা বলছে স্বনামধন্য দুই প্রতিষ্ঠান এসিআইয়ের ধনিয়া, প্রাণের হলুদ এবং কারি মশলায় মেশানো হয়েছে ছাই।
রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান মনে করেন, প্যাকেটজাত পণ্যের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা করছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসলে এবং ভোক্তারা এসব প্রতিষ্ঠানের ভোগ্যপণ্য থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে সমাধান আসার সুযোগ আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যে দামে প্যাকেট করা মসলা বা হলুদ, মরিচ কিনি, তার আসল দাম কিন্তু এত না। আমরা জেনেশুনেও বেশি দাম দিতে রাজি, কারণ আমরা বেশি টাকা দিয়ে হলেও ভালো জিনিসটা চাই। কিন্তু আসলে আমাদের কী খাওয়ানো হচ্ছে… এগুলোর বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
সম্প্রতি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ৫২টি ভোগ্যপণ্য পরীক্ষা করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেয় বিএসটিআই। যেখানে দেখা গেছে, এসিআই, প্রাণ, সিটি গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের মতো প্রতিষ্ঠানের সব খাদ্যপণ্যও নিরাপদ নয়। আবার পণ্যের মানের পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে দামের বিষয়ে। মূল দামের চাইতে চার থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত বাড়তি দাম নেয়ার পরেও ভোক্তাদের মানসম্মত পণ্য দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
ভেজাল পাওয়া গেছে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় থাকা লবণ, ধনিয়া, হলুদের মতো পণ্যে। বাদ যায়নি সেমাই, তেল, চিপসের মতো পণ্যও।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাজারে দুই ধরনের ধনিয়া পাওয়া যায়। একটি রাশিয়ান, অন্যটি দেশি। ভালোমানের হিসেবে রাশিয়ান ধনিয়ার কদর দেশের বাজারে সব সময়ই বেশি। ক্রেতাদেরও আগ্রহ আছে এটির প্রতি। মৌসুমের সময় বা মৌসুম ছাড়া এর দামের তেমন কোনো পরিবর্তন থাকে না।
ব্যবসায়ীরা জানান, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আস্ত রাশিয়ান ধনিয়া বিক্রি হয় একশো থেকে ১২০ টাকা দরে। আর দেশি ধনিয়ার দাম কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর পাইকারি বাজারে এই দর আরও কম। দেশের উত্তরাঞ্চলে ধনিয়ার চাষ হয়। সেখানে মৌসুমের সময় প্রতি মণ ধনিয়া বিক্রি হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী সিদ্দিক জোয়ার্দার জানান, তারা খোলা হলুদ আস্ত ও গুঁড়া দুটোই বিক্রি করেন। কেউ কেউ আস্ত হলুদ নিয়ে নিজেরা তা গুঁড়া করে নেন, কেউবা খোলা হলুদ গুঁড়া তাদের থেকে নিয়ে ব্যবহার করেন। বলেন, ‘যারা খোলাটা নেয় তাদের কোনো আপত্তি আমরা পাই না। কিন্তু যারা প্যাকেটের নামে ভালো পণ্য বলছে, তারা এগুলো কী করল? এটা আসলে কেউ মানতে পারবে না। আমরাও তো ব্যবসায়ী হওয়ার আগে নিজেরাও ভোক্তা।’
উন্নত দেশের কাতারে থাকা দেশগুলোর মতো ভেজাল পণ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান রিয়াদ হোসেন মাটি। পেশায় মুদি ব্যবসায়ী মাটি বলেন, ‘আমরা কাস্টমারকে বলি এই কোম্পানির পণ্য দিতে পারেন, এটা ভালো কোম্পানি। কিন্তু যে কাহিনি দেখলাম তাতে এখন আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। কাদের ভালো বললাম? মানুষকে বলি খোলা জিনিস না নিয়ে প্যাকেট করাটা নেন। খোলাটায় ময়লা থাকতে পারে। এখন তো দেখি প্যাকেট করাটার ভেতরেই বেশি ঝামেলা।’
নামি কোম্পানির এই বিশ্বাস ভঙ্গের পরও গত দুই দিনেও এসিআই বা প্রাণের পক্ষ থেকে ভোক্তাদের প্রতি কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। তাদের কেউ ক্ষমা চায়নি, কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আর প্রাণের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা জিয়াউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তাদের অফিসিয়ার বক্তব্য মেইল করে জানিয়ে দেওয়া হবে। বেলা আড়াইটায় এই বক্তব্য দিলেও রাতে এই প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত সেই মেইল আর আসেনি।
গত ২ মে শিল্প মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বিএসটিআই রোজার আগে বাজার থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫২টি নিম্নমানের পণ্য চিহ্নিত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে এবং অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে পুষ্টির মেয়াদোত্তীর্ণ ভোজ্যতেল বাজারজাতের বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর এসব খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার, জব্দ ও মান উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ৮ মে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটির (সিসিএস) পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান এই রিট আবেদন করেন।
পরদিন ওই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে মানহীন খাদ্যপণ্যের তালিকা দেখে বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘কোনো কোম্পানিই তো বাদ নাই।’
এসব পণ্যের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা জানাতে আদালত বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দুজন কর্মকর্তাকে তলব করে। পরে রবিবার উচ্চ আদালত ৫২ ধরনের খাদ্য বাজার থেকে তুলে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।