খেলা ডেস্ক
প্রতিযোগিতা, রোমাঞ্চের দিক দিয়ে ইউরোপে প্রিমিয়ার লিগ সবসময়ই বাকি লিগগুলোর চেয়ে এগিয়ে। এই মৌসুমের রোমাঞ্চ যেন হার মানায় হলিউডের কোনও থ্রিলার সিনেমাকেও। জানুয়ারিতে ম্যানচেস্টার সিটি-লিভারপুল ম্যাচে সাদিও মানের শট গোললাইন থেকে ১১ মিলিমিটার দূরে থাকতে জন স্টোনসের ফিরিয়ে দেওয়া, বা বার্নলির বিপক্ষে ২৯ মিলিমিটারের জন্য সার্জিও আগুয়েরোর শট গোললাইন অতিক্রম করা; নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মাঠে শেষদিকে ডিভক ওরিগির গোল, বা লেস্টার সিটির বিপক্ষে শেষদিকে সিটি অধিনায়ক ভিনসেন্ট কম্পানির আগুনে শট- সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে নির্ভর করছে এবারের শিরোপা।
সাম্প্রতিক সময়ে ইংলিশ লিগের শ্রেষ্ঠত্ব দখলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইটা দেখা মেলেনি তেমন। চেলসি বা ম্যানচেস্টার সিটির সবাই লিগ জিতে গিয়েছিল মৌসুমের শেষদিনের আগেই। তবে এবার ২০১১-১২ প্রিমিয়ার লিগের সেই রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তি ফিরতে পারে এবারও। ৩৭ ম্যাচ শেষে পেপ গার্দিওলার পয়েন্ট ৯৫, ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুলের ৯৪। শেষ ম্যাচে জিতলে তাদের পয়েন্ট হবে ৯৭। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট হবে না, যদি সিটি জিতে যায় ব্রাইটনের বিপক্ষে। লিভারপুলের জন্য তাই সেটা তাদের যতটা না ব্যর্থতা, তার চেয়েও বেশি হবে হতাশার। সেই ১৯৯১-৯২ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ ফরম্যাটের পর থেকে হয়ে যাওয়া ২৭ মৌসুমের ২৫টিতেই এই পয়েন্ট নিয়ে লিগ জিততে পারত তারা। ১৩বার প্রিমিয়ার লিগ জেতা স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ সংগ্রহ ছিল ৯১ পয়েন্ট।
এই মৌসুমে সিটিকে রীতিমত সব দিক দিয়েই টেক্কা দিয়েছে লিভাপুল। রক্ষণ নিয়ে গত কয়েক মৌসুম ধরেই বেশ সমালোচনা সইতে হয়েছে ‘অল রেড’দের। কিন্তু পিএফএ বর্ষসেরা ফুটবলার ভার্জিল ভ্যান ডাইক, জোয়েল মাতিপদের কল্যাণে এবার লিগে সিটির সমান মাত্র ২২ গোল হজম করেছে তারা। জাল খুঁজে পাওয়ার দিক দিয়েও এবার সিটির (৯১) একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলই (৮৭)। প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ গোলদাতাদের প্রথম ৪জনই এই দুই দলের (সালাহ, মানে, আগুয়েরো, স্টার্লিং)।
শেষদিনে ফলাফল যাই হোক, ১৯৯২-৯৩ মৌসুমের পর ইউরোপে সেরা পাঁচ লিগে ৯০+ পয়েন্ট নিয়েও লিগ না জেতার রেকর্ড হবে আবারও। সিটি, ব্রাইটনকে হারিয়ে দিলে এই শতাব্দীতে প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগ জেতার এত কাছে এসেও খালি হাতে ফেরার দায়ভারটা হবে লিভারপুলেরই। জানুয়ারিতে সিটির মাঠে খেলতে যাওয়ার আগে গার্দিওলার দলের চেয়ে ৭ পয়েন্টে এগিয়ে ছিল লিভারপুল। জিতলে বা ড্র করলেই লিগের লাগামটা নিজেদের হাতেই থাকত ক্লপের দলের।
কিন্তু ২-১ গোলের হারের পরই ছন্দ হারাতে থাকে লিভারপুল। নতুন বছরের প্রথম ৬ ম্যাচে ৮ পয়েন্ট হারায় ক্লপের দল, সাথে হারায় শীর্ষস্থানও। মৌসুম যখন বছরখানেকের, তখন এমন ছন্দপতন খুবই স্বাভাবিক। মৌসুমের মাঝামাঝি ছন্দ হারানো সিটি অবশ্য ফিরেছে দারুণভাবেই। জানুয়ারিতে ছন্দপতনের পর ফিরেছে লিভারপুলও, কিন্তু পুরো মৌসুমে এই রুদ্ধশ্বাস প্রিমিয়ার লিগ দৌড়ের ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’-এর হাতবদল হয়েছে মোট ৩২বার।
তবে শেষটা যেমনই হোক, পুরো মৌসুমজুড়ে লিভারপুলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সিটি প্রিমিয়ার লিগে দারুণ ফর্মে থাকলেও বিদায় নিয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে। আর লিভারপুল চলে গেছে টানা দ্বিতীয় ফাইনালে। দুই ম্যাচের ওপর ঝুলছে লিভারপুলের শিরোপা সম্ভাবনা। এখনও নিশ্চিত নয় কিছুই, তবে এমন পারফরম্যান্সের পরই হয়তো দ্বিতীয় হওয়ার জন্যও শিরোপা প্রাপ্য লিভারপুলের- টকস্পোর্টে ‘অল রেড’ সমর্থক ক্যামেরনের এমন দাবি হাস্যকর শোনায় না তেমন।
শেষ ১৩ ম্যাচ জিতে প্রিমিয়ার লিগ ধরে রাখার বল এখনও সিটিরই কোর্টে। কিন্তু প্রতিপক্ষ ব্রাইটন অ্যান্ড হভ আলবিওনের বিপক্ষে জয়টা এত সহজেও নাও আসতে পারে গার্দিওলার দলের। এফএ কাপের সেমিতে সিটির কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল ‘সিগাল’রা। কিন্তু সে ম্যাচে সিটির রক্ষণভাগকে বেশ ভুগিয়েছিল তারা। ওয়েম্বলির সেই পারফরম্যান্স আগামীকাল অ্যামেক্স স্টেডিয়ামে ফিরিয়ে আনতে পারলে হয়তো ২০১১-১২ এর রোমাঞ্চ ফিরেও আসতে পারে এবার।
অ্যানফিল্ডে টানা ৪০ ম্যাচ অপরাজিত থাকলেও আগামীকাল উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে সতর্ক থাকতে হবে লিভারপুলকে। এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’ উলভস। ম্যান ইউনাইটেড, চেলসি, আর্সেনালকে এই মৌসুমেই হারিয়েছে তারা, রুখে দিয়েছে সিটিকেও। তবে অ্যানফিল্ডে সালাহ-মানেদের ৯০ মিনিট রুখে দেওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্যই হবে ক্লপের দলের জন্য। আগামীকালের অপেক্ষমান রোমাঞ্চ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ২০১১-১২ মৌসুমে।
শেষ ম্যাচের আগে ইউনাইটেড এবং সিটি দুই দলেরই পয়েন্ট ছিল ৮৬। শেষ ম্যাচে সান্ডারল্যান্ডকে হারিয়েছিল ইউনাইটেড। ৯০ মিনিট পর্যন্ত ইতিহাসে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষে ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিল সিটি। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে সমতায় ফিরিয়েছিলেন এডিন জেকো, কিন্তু তখনও দরকার এক গোল। ইউনাইটেড যখন শিরোপা উল্লাসের প্রস্তুতিতে মত্ত, ঠিক তখনই ইংল্যান্ড দেখল অবিশ্বাস্য কিছু। ৯৩ মিনিটে সার্জিও আগুয়েরোর গোলে ইউনাইটেডকে হতবাক করে প্রথমবারের মত লিগ জিতল সিটি। ৭ বছর আগের দলে সেই কম্পানি, সিলভা, আগুয়েরোরা আছেন এখনও। স্টার্লিং, সানেদের মত তরুণরা তাই শেষ ম্যাচের দিন চাপে ভেঙ্গে না পড়াটা অনুপ্রেরণা পেতে পারেন আগুয়েরোদের থেকেই।