বিদেশ ডেস্ক
শান্তিপূর্ণ বলে দেশটির সুনাম আছে। আর সেখানেই কিনা থাবা বসাল জঙ্গিরা। কিন্তু কেন নিউজিল্যান্ডে এমন ভয়ানক সন্ত্রাসী হামলা হলো? এটি কি কাকতাল মাত্র, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার প্রভাব আছে?
ব্রেনটন টারান্ট নামে অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত ২৮ বছর বয়সী তরুণ গতকাল শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে স্থানীয় সময় বেলা দেড়টার দিকে জুমার নামাজ চলাকালে মুসল্লিদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। কাছাকাছি লিনউড মসজিদে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালানো হয়। দুই মসজিদে হামলায় প্রাণ হারান ৪৯ জন। এর মধ্যে আল নূর মসজিদে ৪১ জন ও লিনউড মসজিদে ৭ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও ৪৮ জন। এরই মধ্যে ব্রেনটনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে নিউজিল্যান্ডের পুলিশ।
ক্রাইস্টচার্চের মতো নারকীয় হত্যাকাণ্ড নিউজিল্যান্ডে বিরল। এমন মাত্রার অপরাধের মোক্ষম উদাহরণ খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৪৩ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় এমন একটি অপরাধ দেশটিতে সংঘটিত হয়েছিল। নিকট অতীতের উদাহরণ খুঁজতেও ফিরে যেতে হবে গত শতাব্দীতে। ১৯৯০ সালের সেই ঘটনায় ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছিল, কারণ ছিল প্রতিবেশীর সঙ্গে মনোমালিন্য। কিন্তু এবার যে ঘটনাটি ঘটল, তার সঙ্গে সরাসরি উগ্রবাদের সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
অথচ আমেরিকার ইরাক বা আফগানিস্তানে হামলা, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানের সময়ও নিউজিল্যান্ড সুরক্ষিত ছিল। কখনোই সেখানে মৌলবাদ বা উগ্রবাদ–সম্পর্কিত কোনো গুরুতর অপরাধ ঘটতে দেখা যায়নি। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনার পর হুট করেই আপাত শান্তিপূর্ণ একটি দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা–সংশ্লিষ্ট কিছু নিয়মকানুনও পাল্টে ফেলার কথা ভাবছে নিউজিল্যান্ডের সরকার।
গত কয়েক বছরে শুধু দুর্ঘটনার কারণেই বিশ্বের গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে নিউজিল্যান্ড। ২০১১ সালে ক্রাইস্টচার্চে আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে ১৮৫ জন নিহত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালেও এক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল নিউজিল্যান্ড, নিহত হয়েছিলেন ২ জন। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানোর কিছু সুনির্দিষ্ট উপায় অন্তত বের করা যায়। কিন্তু মানুষই যখন মানুষের শত্রু হয়ে যায়, তখন তা প্রতিরোধ অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিউজল্যান্ডে কখনোই বর্ণবাদ বা উগ্রবাদের প্রকাশ্য আস্ফালন দেখা যায়নি। দেশটির সরকার ব্যবস্থা সব সময়ই স্থিতিশীল, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা হানাহানিও নেই তেমন। নিউজিল্যান্ডে অভিবাসীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। তবে পারস্পরিক ঘৃণার প্রকাশ বা বিভক্তির নিদর্শন উল্লেখযোগ্য নয়। তবে হ্যাঁ, ধীরে ধীরে দেশটিতে অভিবাসনবিরোধী একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে। নিউজিল্যান্ডে তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি কট্টর জাতীয়তাবাদী। সাম্প্রতিক নির্বাচনে এই দলটি বেশ ভোট পেয়েছে। এই দলের প্রধান নেতা ম্যাভেরিক উইনস্টন পিটারস এখন দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী। দলটি দেশের বর্তমান উদার অভিবাসন নীতি কঠোর করতে চায়। ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ড প্রায় ৬৫ হাজার অভিবাসীকে স্বাগত জানিয়েছে। এই সংখ্যা কমিয়ে ১০ হাজারে নামাতে চান পিটারসরা। সাম্প্রতিক হামলার পর সেই পালে আরও হাওয়া লাগতে পারে বলেও আশঙ্কা আছে।
নিউজিল্যান্ডের সর্বশেষ আদমশুমারিতে দেখা গেছে, ক্রাইস্টচার্চে শ্বেতাঙ্গদের আধিক্য বেশি, প্রায় ৮৪ শতাংশ। অন্যদিকে পুরো দেশে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা ৭৪ শতাংশ। ২০০৪ সাল থেকেই দেশটিতে এশীয় অভিবাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়ে আসছে, যদিও তার পরিসর খুব একটা বড় নয়। ক্রাইস্টচার্চের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ অভিবাসী। স্থানীয় সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘রাইট উইং রেজিসট্যান্স’ নামের একটি বর্ণবাদী গোষ্ঠী নিউজিল্যান্ডে সক্রিয় আছে অনেক দিন ধরেই। সুতরাং দেশটিতে বর্ণবাদের ছিটেফোঁটাও নেই, এটি বলা ভুল হবে।
নিউজিল্যান্ডের রাজনীতিতে ইসলামভীতির বিষয়টি কখনোই প্রধান বিষয় নয়। মুসলিমদের সংখ্যাও কম, সব মিলিয়ে ৫০ হাজারও হবে না। তবে হ্যাঁ, ইদানীং দেশটিতে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব দেশের তালিকায় ওপরের দিকে আছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র কিছু চিহ্ন ক্রাইস্টচার্চেও দেখা গেছে। ২০১২ সালে ক্যান্টারবুরি ডিস্ট্রিক্ট হেলথ বোর্ড এবং মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্রাইস্টচার্চে বেশ কিছু উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। ওই বছরই শতাধিক মানুষ সেখানে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র সমর্থনে বিক্ষোভও করেছিল। ২০১৭ সালে দেশটির পার্লামেন্টের সামনেও এমন একটি বিক্ষোভ হয়েছিল। তবে অনেকের দাবি, এসবই হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ক্রাইস্টচার্চের সাবেক মেয়র ভিকি বাক বর্ণবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন, কয়েকটি ঘটনায় পুরো সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় না।
অবশ্য একটি বিষয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ক্রাইস্টচার্চে শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলা উগ্রবাদের প্রভাবেই ঘটেছে। বিশ্লেষকদের যুক্তি, হুট করেই এমনটা হতে পারে না। তাই এখন নিউজিল্যান্ডের সরকারি কর্তৃপক্ষের উচিত, এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা।
অবশ্য ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলার পর সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে নিউজিল্যান্ডের অস্ত্র আইন নিয়ে। স্থানীয় বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাত্র ২৫ ডলার খরচ করেই বাইরের দেশ থেকে আসা যে কেউ নিউজিল্যান্ডে অস্ত্র চালানোর লাইসেন্স পেতে পারে। এর জন্য কিউই পুলিশের কাছে পর্যটকদের দেখাতে হয় যে, নিজের দেশে তাঁদের অস্ত্র চালানোর লাইসেন্স আছে। কিন্তু তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার রীতি এত কঠোর নয়। শিকারের কথা বলেও যেকোনো পর্যটক সেখানে অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে পারেন, আর এটি কার্যকর থাকে ১২ মাস পর্যন্ত! কেনা যায় স্বয়ংক্রিয় রাইফেলও।
জানা গেছে, ক্রাইস্টচার্চে হামলা চালানো সন্ত্রাসী ব্রেনটন টারান্ট বৈধ অস্ত্র বহন করছিলেন। এতে হামলায় ব্যবহৃত গুলি কিনতে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। নিউজিল্যান্ডের সরকার এখন বলছে, দেশটির অস্ত্র আইনে শিগগিরই পরিবর্তন আনা হবে। হামলার দিনই দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলে দিয়েছেন, ‘যেহেতু এ ধরনের ঘটনা একের পর ঘটেই যাচ্ছে আর এগুলো ঘটছে লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়েই, তাই আমি ঠিক এই মুহূর্তে আপনাদের বলতে পারি…আমাদের অস্ত্র আইনে পরিবর্তন আসবে।’
অর্থাৎ ‘শান্তির দেশ’ নিউজিল্যান্ডে পরিবর্তন আসছেই। কঠোর হবে অস্ত্র আইন, পরিবর্তন আসতে পারে অভিবাসন নীতিতেও। সে ক্ষেত্রে সবুজে ঘেরা দ্বীপদেশটির উদার মনোভাব সংকুচিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।