খেলা ডেস্ক
টেস্ট ক্রিকেটও যে কখনো কখনো রোমাঞ্চে-উত্তেজনায় থ্রিলার উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্রকেও ছাপিয়ে যায়, তারই সাক্ষী হয়ে থাকল ডারবান। সিরিজের প্রথম টেস্টেই সফরকারী শ্রীলঙ্কা স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিল। ৩০৪ রানের কিলিমাঞ্জারো পর্বত ডিঙানোর চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে গেল ১ উইকেটে। মাত্র ১ উইকেটের জয়ই বলে দিচ্ছে প্রতিটা রানের জন্য কতটা রোমাঞ্চ জমে ছিল ম্যাচের চতুর্থ দিনে। শ্রীলঙ্কার জয়ের চেয়েও অবিশ্বাস্য কুশল পেরেরার ১৫৩ রানের ইনিংস। বীরত্ব বললেও যাকে কম বলা হয়।
ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি, সেটিও এল আড়াই বছর পর। ৩০৯ মিনিট স্থায়ী ১২টি চার ও ৫ ছক্কার ইনিংসটি খেলার পর পেরেরার আর কিছু না করলেও চলবে! শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে এই এক ইনিংস দিয়ে পাকা জায়গা করে নিলেন। ৫ ছক্কার সব কটিই ৭১ ওভারের পর। শ্রীলঙ্কা ৭০ ওভারেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে ২২৬ রানে। জয় তখনো ৭৮ রান দূরে। শেষ ব্যাটসম্যান বিশ্ব ফার্নান্দোকে নিয়ে এই দীর্ঘ দুরূহ পথই পাড়ি দিলেন কুশল!
এর মধ্যে ফার্নান্দোর অবদান মাত্র ৬ রান, যার ৫-ই এসেছে ওভার থ্রোয়ের সুবাদে আসা বাউন্ডারি থেকে। তবে কোনোভাবেই ক্যারিয়ারের মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা ফার্নান্দোর অবদান খাটো করা যাবে না। অন্য প্রান্তে যে এক ঘণ্টারও বেশি সময় সঙ্গ দিয়েছেন কুশলকে। সাতে নেমে ৪৮ রানের ইনিংস খেলা ধনাঞ্জয়া ডি সিলভাকেও তাই কৃতিত্ব দিতে হবে।
তবে কুশলের কীর্তি এমনই বিশাল, বাকিরা নিজেরাই আড়ালে চলে যেতে নাখোশ হবেন না। লক্ষ্য হিসেবে চতুর্থ ইনিংসে ৩০৪ রান বোঝাতে কঠিন-এর সঙ্গে তম জুড়ে দিয়েও ঠিক জুতসই হচ্ছে না। সেটিও যদি হয় দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রোটিয়া এক্সপ্রেস বোলারদের সামনে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে তিন শতাধিক রান তাড়া করে হারিয়েছে মাত্র একটিই দল (তিনবারই অস্ট্রেলিয়া; ২০০২, ২০০২ ও ২০১১)।
কুশলের কীর্তিটা লিখে বা বলে বোঝানো সত্যিই কঠিন। যখন উইকেটে এসেছিলেন, ৫২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা তখন কাঁপছে। সেটা অবশ্য কালকের ঘটনা। নিজে ১২ রানে অপরাজিত থেকে তৃতীয় দিন শেষ করেছিলেন। আজ প্রথম সেশনেই দেখলেন, ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বাকি যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও অসম্ভবের পিছে ছুটতে চাইলেন না। ১১০ রানে ৫ উইকেট। লড়াই করার আর কীই-বা থাকে!
ধনাঞ্জয়াকে নিয়ে কুশলের ষষ্ঠ উইকেটের ১০৪ রানের জুটিটা একটু অবাকই করল। পরপর দুই বলে ধনাঞ্জয়া ও সুরঙ্গা লাকমলকে ফিরিয়ে সাময়িক উত্তেজনা নিভিয়ে দিলেন কেশব মহারাজ। সত্যি বলতে, এই টেস্ট নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমী বলে সুখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকার দর্শকদেরই আগ্রহ ছিল না। খাঁ খাঁ গ্যালারি। পরের দুই ব্যাটসম্যান ৪ ও ১ রান করে ফিরে দক্ষিণ আফ্রিকার আরও একটি সহজ জয়কে সময়ের ব্যাপার বানিয়ে দিলেন। ২২৯ রানে শ্রীলঙ্কার ৯ উইকেট নেই! সেখান থেকেই লড়াই করে ম্যাচটা এমন নাটকীয়ভাবে ঘুরিয়ে দিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করা লঙ্কানপ্রবাসীদের জন্য আক্ষেপ বাড়ল। ঐতিহাসিক এক জয় থেকে যে বঞ্চিত হতে হলো!
কুশলও কি জানতেন এর পর কী হতে চলেছে? নবম উইকেট পতনের সময় ১৩২ বলে ৮৬ রানে অপরাজিত। ইনিংসের ৭১তম ওভারটা দেখে শুনে খেললেন। যেন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেন কী করবেন। সিদ্ধান্ত স্থির হতেই ৭২তম ওভারের প্রথম বলে মহারাজকেই ছক্কাটা হাঁকালেন। নিজের চার ওভারে তিন উইকেট তুলে নিয়ে এই মহারাজই শ্রীলঙ্কাকে পরাজয় দেখাচ্ছিলেন।
সেই যে শুরু, এরপর প্রতিটি বল কী স্থির প্রতিজ্ঞায় খেলেছেন! এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে রান তাড়া করতে হয়, সেটিরই যেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। পারতপক্ষে স্ট্রাইকিং প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে ঝুঁকি নিতে দেনইনি। নিবৃত্ত করেছেন। যতটা সম্ভব নিজে থেকেছেন স্ট্রাইকিং প্রান্তে। সুযোগ বুঝে ছক্কাও হাঁকিয়েছেন, না হলে যে প্রতিটা রানের জন্য অনন্ত অপেক্ষায় কাটত সময়।
এসব ক্ষেত্রে যা হয়, রানের ব্যবধান কমলেই বরং ব্যাটিং দলের ওপর চাপ বাড়ে। একসময় চাপমুক্ত হয়ে খেলা যায়, ৭৮ রান দূরে থেকে ১ উইকেট রেখে কেইবা আর জয়ের প্রত্যাশা করে। কিন্তু জয় দিগন্তে উঁকি দিতে শুরু করলেই তো চাপ! সেই চাপও কুশল সামলেছেন। আর দক্ষিণ আফ্রিকা যে চাপ সামলাতে পারে না, সেটির নজির মিলল আরও একবার। স্টেইনের দুই ওভারে অনায়াস দুই ছক্কা যেন সেই চাপেরই ফসল। এমনকি এ সময়ের সেরা বোলার কাগিসো রাবাদাকেও এক ওভারে ছক্কা অন্য ওভারে চার হাঁকালেন। রাবাদার বলে চার দিয়েই জয়ের বন্দরে গেছে শ্রীলঙ্কা। কুশলের অপরাজিত ইনিংসটার মধুরেণ সমাপয়েৎ ছিল এই বাউন্ডারি।
নবম উইকেট পড়ার পর ৬৮ বলে ৬৭ রান, কুশলের বীরত্বের সাক্ষী হয়ে থাকল এই পরিসংখ্যানও। এই টেস্ট তো আসলে কুশলই জিতলেন!