অনলাইন
রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিরিয়ে আনতে ও দোষীদের বিচারে গতকাল বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা করেছে বাংলাদেশ। মামলায় অভিযোগ করা হয়, প্রায় তিন বছর আগে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ১০ লাখ ডলার অজ্ঞাতনামা হ্যাকাররা হাতিয়ে নেয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির সঙ্গে ফিলিপাইনের রিজাল কর্মাশিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) ব্যাংকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও এর শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িত
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে করা মামলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগে বলা হয়, ব্যাংকটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা এই অর্থ চুরির জন্য কয়েক বছর ধরে ‘বড় ধরনের’ ‘জটিল ষড়যন্ত্র’ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অজ্ঞাতনামা উত্তর কোরীয় হ্যাকাররা এই চুরিতে সহায়তা করেছে। অর্থ চুরির পর তা নিউইয়র্ক সিটি ও ফিলিপাইনে আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। পরে এই অর্থের বেশির ভাগ ফিলিপাইনের ক্যাসিনোর মাধ্যমে পাচার করে দেওয়া হয়।
তবে মামলার ব্যাপারে আরসিবিসির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ মামলা করতে যাচ্ছে এটা জানতে পেরে গত বুধবার আরসিবিসি এক বিবৃতিতে জানায়, তারা এই অভিযোগের বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছে। এর ফলে আরসিবিসির জন্য সুযোগ হয়েছে আবারও তথ্য উপস্থাপন করা যে, তারা ঘটনার শিকার হয়েছে। চুরির ঘটনাটি বাংলাদেশ থেকে শুরু হয়েছে এবং এতে অজ্ঞাতনামা লোকজন জড়িত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ফজলে কবির বুধবার বলেন, এই মামলায় সহায়তা দিতে নিউইয়র্ক ফেড বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তবে নিউইয়র্ক ফেডের মুখপাত্র সহায়তার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
জানা যায়, হ্যাকাররা প্রায় ১০০ কোটি ডলার চুরি করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তবে তারা ১০ কোটি ১০ ডলার চুরি করতে পারে। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার শ্রীলংকার একটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এর মধ্যে বানান ভুলের কারণে শ্রীলংকার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা অর্থ ফেরত আসে। ২০১৬ সালের আগস্টে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুরির অর্থ স্থানান্তর বন্ধে ব্যর্থতার কারণে আরসিবিসি ব্যাংককে রেকর্ড পরিমাণ ১৯ মিলিয়ন ডলার বা ১ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানা করে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থ চুরির ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ পায় মার্চে। এ ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। দুই ডেপুটি গভর্নরকেও সরিয়ে দেয় সরকার। ঘটনা তদন্তে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে কমিটি করে সরকার। বারবার আশ্বাস দিলেও সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেননি সদ্য বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। পরের দুই দিন সরকারি ছুটি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে অর্থ বের করতে সেদিন রাতকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। ওই রাতেই ১৯৩ কোটি ডলার বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সব আদেশ কার্যকর না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত চুরি হয় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার।
অর্থ স্থানান্তরের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সেবাদাতা সংস্থা সুইফটকে (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) হ্যাক করেই এ অর্থ চুরি করা হয়। সুইফটের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের কোনো আদেশ দেওয়া হলে তার একটি কপি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদেশদাতা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রিন্ট হওয়ার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি এসব অর্থ পরিশোধের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চায় ফেড। এরপরই বিষয়টি জানতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগেই অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তর হয়ে যায়।
অর্থ স্থানান্তর হয়ে যাওয়ার পর ১১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে ফোন করে অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে সহায়তা চান। ১৪ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিদল। এরপর দফায় দফায় সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, গভর্নরসহ আরও অনেকে অর্থ উদ্ধার নিয়ে ফিলিপাইন, সুইফট কর্তৃপক্ষ ও ফেডের সঙ্গে সভা করে। ঘটনার তিন বছরের মাথায় মামলাটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দায়িত্ব পাওয়ার পর সিআইডি বারবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছে।