নিজস্ব প্রতিবেদক
একাদশ নির্বাচনে ফলাফল বিপর্যয়ের পর কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যের কাছ থেকে। শুক্রবার বিকালে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদের বক্তব্যে সরাসরি দল পূনর্গঠনের কথা উঠে আসে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যের ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হলে দলকে পূনর্গঠন করতে হবে। ২০০৮ সালে এমনিভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজিত হয়েছিলাম। তারপর কিন্তু আমরা দলের কাউন্সিল করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম এবং সারা দেশে আমাদের নেতা-কর্মীরা সাহসের সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো এবং সেটার প্রমাণ ৩০ তারিখে যে সরকার ভোট করতে সাহস পেলো না।”
তিনি বলেন, ‘‘একটি কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে পূনর্গঠন করতে হবে। তুলনামূলকভাবে ত্যাগী এবং এই নির্বাচনে যারা পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদেরকে নেতৃত্বে আনতে হবে। আমরা যারা ব্যর্থ বলে পরিচিত হয়েছি তাদের পদ ছেড়ে দিতে হবে তরুনদের জন্য। তাহলেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে।”
কুমিল্লা-১ ও কুমিল্লা-২ আসনের ধানের শীষের প্রার্থী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ শহীদ জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির মার্কাকে, বেগম খালেদা জিয়ার মার্কাকে ভয় পায়। তারা যে ভয় পায় তার বড় প্রমাণ যে, ৩০ তারিখে জনগনকে কেন্দ্রে আসার সুযোগ দেয় নাই, ২৯ তারিখ রাতে ভোটের কাজ শেষ, ভোটের ডাকাতি শেষ। জনগনের অধিকারকে ডাকাতি করা হয়েছে। আজকে যারা বলেন যে,বিএনপি পরাজিত হয়ে এসেছে। আমি পরাজিত হয়ে এসেছি বলে মানতে পারি না। আমরা মনে করি, জনগনের কাছে আমাদের বিজয় হয়েছে, নৈতিকভাবে বিএনপি ও ধানের শীষ বিজয় হয়েছে। আর নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ। জনগনের মাঝে আমাদের এই বিজয়কে ধরে রাখতে হবে। আমাদের প্রার্থীরা, নেতা-কর্মীরা হতভম্বিত, ভাষা নেই তাদের। আমাদের অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
তিনি বলেন, “দলকে পূনর্গঠন করতে হবে। তাহলে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ-দর্শন এদেশের মানুষ গ্রহন করেছে, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েও থাকে কিংবা একটু হতভম্ব হয়েও থাকি এসময়টা কাটিয়ে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াতে পারলেই জাতীয়তাবাদী দল শক্তিশালী করে জিয়ার আদর্শ সফল করার জন্য আমরা যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই তাহলেই তার জন্মবার্ষিকী সফল হবে।”
এর আগে মওদুদ আহমদ বলেন, “নতুন করে দলকে আবার পূনর্গঠন করতে হবে। যারা দুঃসময়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, যারা দলের জন্য কাজ করেছেন তাদেরকে সামনের দিকে এনে দলকে পূনরর্গঠন করতে হবে। দরকার হলে আমরা যাদের বয়স হয়ে গেছে সরে যাবো তারপরেও এই দলটাকে তো রাখতে হবে। এর একমাত্র উপায় হলো নতুন করে পূনর্গঠন করা। এই কাজ আমাদের কয়েকমাসের মধ্যেই করতে হবে। তাহলেই আমরা আবার মোড় ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।”
নির্বাচনের পরিস্থিতি তুলে ধরে নোয়াখালী-৫ আসনের প্রার্থী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘‘ নির্বাচনের আগের দিন ৪০ শতাংশ ভোট ভরে দিতে হবে-এটা ছিলো নির্দেশ। সেজন্য আমাদের সেই আশা, সেই প্রত্যাশা সম্পূর্ণভাবে ধুলিসাত হয়ে যায় ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্ধ থেকে শুরু করে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এমনকি নির্বাচনের আগেরদিন পর্যন্ত মামলা দিয়েছে। মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের সবাইকে এলাকা ছাড়া করেছে। কাকে নিয়ে নির্বাচন করবো? কর্মী ছাড়া নির্বাচন হয়, যুব দল-ছাত্র দল ছাড়া নির্বাচন সম্ভবপর?“
তিনি বলেন, ‘‘ এটা একটা পূর্বপরিকল্পিত নীল নকশার উপর নির্ভর করে নির্বাচন হয়েছে। এটাকে নির্বাচন বলা চলে না। এটা কখনোই আমাদের সংবিধানসম্মত নির্বাচন হয় নাই। আজকে ৯৭ শতাংশ আসন মহাজোট পেয়েছে-এটা শুনলেই আপনি যদি নিউইয়র্ক টাইমস পড়েন, ওয়াশিংটন পোস্ট পড়েন, গার্ডিয়ার পত্রিকা পড়েন, লন্ডনের অবজারভার পড়েন সারা দুনিয়াতে কেউ বিশ্বাস করে না এটা একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনে চুরি হয়েছে, ভোট চুরির নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনে জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে নাই।”
স্থায়ী কমিটির প্রবীনতম এই সদস্য বলেন, ‘‘ আমাদের ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। আমার কাছে মনে হয় আমাদের এখন দুই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। একটি হচ্ছে পূনর্বাসন। আমাদের সারাদেশে হাজার নেতা-কর্মী ও তাদের পরিবার গত দেড়মাস প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এই নির্বাচন যাওয়ার কারনে। যদি আগে থেকেও তারা ক্ষতিগ্রস্থ ছিলেন। তাদেরকে পূনর্বাসন করতে হবে। এদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, এদের দেখাশুনা করতে হবে, আহতদের সেবা করতে হবে, তাদের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে, যারা পঙ্গ হয়ে গেছে তাদের সেবা করতে হবে, যাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে- এসব পূনর্বাসন কর্মসূচি আমাদের দ্রুত নিতে হবে। কয়েকমাসের মধ্যে এই কর্মসূচি নিতে হবে।”
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে, সেই গণতন্ত্রকে পুরোপুরিভাবে ধবংস করে দেয়া হয়েছে। আজকে সেই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। হতাশার কোনো জায়গায় নেই। অন্ধকারের মধ্য থেকেই আলোতে উঠে আসতে হবে। এখন তরুনদের এগিয়ে আসতে হবে, যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে। এই দেশট্ ারক্ষা করতে হবে। ভোটের অধিকার রক্ষা করতে হবে। যা জিয়াউর রহমান শিখিয়ে গেছেন। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, পরাজিত না হওয়া। পরাজিত বোধ করলেই পরাজিত।
তিনি বলেন, পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ, সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েছে। তারা নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে, তারা জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, জনগন থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই নির্বাচন একটা কাজ করেছে যে, আওয়ামী লীগকে চিরদিনের জন্য মানুষের মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, দলের যে সমস্ত ভাইয়েরা পঙ্গু হয়েছে, যারা কারারুদ্ধ হয়েছেন,ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যে সমস্ত মায়েরা-বোনেরা নির্যাতিত হয়েছে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে গণতন্ত্রের মাতা বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বের করে আনতে হবে। সেজন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমগ্র দেশে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দূর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেত্রীকে মুক্ত করতে হবে, ভাইদের মুক্ত করতে হবে, গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে-এই শপথ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীর কম উপস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর বীরোত্তম বলেন, ‘‘ কিছুদিন আগে আমাদের এক সেট ব্যাক হয়ে গেছে। এতে হতাশার কিছু নেই। আবার আমরা অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবোই।”
তিনি বলেন, “ অনেকে জানেন বৃটেনের এক সময়ে মার্গারেট থ্যাচারের কথা। তার নেতৃত্বে লেবার পার্টি আমাদের মতো কারচুপির ভোটে নয়, সুষ্ঠু ভোটেই মাত্র ২৪ আসন পেয়েছিলো। সেই থ্যাচারের লেবার পার্টি থেমে থাকেনি। একদিন সেই লেবার পার্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো, টনি ব্ল্যোয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাই হতাশার কিছু নেই। নেতা-কর্মীদের বলব, হতাশ হবেন না।”
তিনি বলেন, যারা বর্তমানে দলের নেতৃত্বে আছেন তাদেরকে আরো একটিভ হতে হবে। জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে নেতৃত্বকে এগিয়ে যেতে হবে। এটা না করতে পারলে এই নেতৃত্বে সেখানে থাকার প্রয়োজন নেই।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৮৩ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে বিএনপি। সুপ্রিম কোর্টের এই আলোচনা অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিলো তুলনামূলকভাবে কম। নির্বাহী কমিটির কয়েকজন ছাড়া কেউই ছিলেন না। মিলনায়তনে অর্ধেক আসনই ছিলো শূন্য। প্রচার সম্পাদক শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদের পরিচালনায় আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, আবদুল মান্নান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিলকিস জাহান শিরিনসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।