২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:৪৩

কুরআনের সব আয়াতের ব্যাখ্যা জানা কি আবশ্যক?

কুরআন আল্লাহর কিতাব। এ কিতাবের আয়াতগুলো ইতিহাস, বিধান, ইবাদত ইত্যাদি ভাগে ভাগ হলেও আলোচ্য বিষয়ের দিক থেকেও বিভক্তি রয়েছে। এর মধ্যে কিছু আয়াত রয়েছে যেগুলো ভাব-বিষয় মানুষের জন্য নির্ধারিত। আর এর ভাব ও মর্ম মানুষের জানা আছে।

আল্লাহ তাআলা কুরআনের আয়াতের বিভক্তি সম্পর্কে মানুষকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, কুরআনের সব আয়াতের ভাব ও মর্ম মানুষের বোধগম্য নয়। যেগুলো সুস্পষ্ট সেগুলো মানা জরুরি। আর যেগুলোর ভাব ও মর্ম শুধু আল্লাহই ভালো জানেন, সেগুলো নিয়ে মানুষের চিন্তা গবেষণা তথা বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।

সুতরাং যে আয়াতগুলো সুস্পষ্ট তা মেনে নেয়া আর যেগুলোর মর্মার্থ অস্পষ্ট সেগুলোর পেছনে সময় ব্যয় না করাই উত্তম। মানুষের কাছে কুরআনের ভাব ও মর্ম সম্পর্কিত আয়াতের বর্ণনা সুস্পষ্ট করতে আল্লাহ তাআলা বলেন-


আয়াতের অনুবাদ
তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি আপনার কাছে কিতাব নাজিল করেছেন। যার কোনো কোনো আয়াত প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট অর্থ প্রকাশ করে, এ আয়াতসমূহ হলো এ কিতাবের মূল (আলোচ্য বিষয়)। আর কিছু আয়াত আছে যার অর্থ অজানা বা অস্পষ্ট, অতঃপর যাদের অন্তরে বক্রতা আছে তারা অশান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যার পেছনে ছুটতে থাকে। অথচ আল্লাহ ব্যতিত এর মর্ম আর কেউ জানে না এবং (এ আয়াতের ব্যাপারে) যারা জ্ঞানবান তারা বলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, সব কিছুই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এবং বুদ্ধমানগণ ব্যতিত অন্য কেউ নসিহত কবুল করতে পারে না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৭)

আয়াতের পরিচয় ও নাজিলের কারণ
কুরআনুল কারিমের সুরা আল-ইমরানের ৭নং আয়াত এটি। মানুষের প্রয়োজনীয় কুরআনের আয়াতগুলো কী কী সে ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। কোন কোন আয়াতের ব্যাখ্যা করা যাবে আর কোনগুলোর ব্যাখ্যা করা যাবে না সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা তুলে ধরেছেন এ আয়াতে।

নবম হিজরিতে যখন নাজরান প্রতিনিধি দল প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসে তখন এ সুরার প্রথম ৮৩ আয়াত নাজিল হয়। সে প্রতিনিধি দল প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের বিষয়ে নানা বিষয় জিজ্ঞাসাবাদ করে।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাজরান প্রতিনিধি দলের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করে। এক পর্যায়ে নাজরান প্রতিনিধি দল তাদের মতের পক্ষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে।

তখন তারা বলে যে, আপনিতো হজরত ঈসা আলাইহিস সালামকে ‘রুহুল্লাহ’, ‘কালেমাতুল্লাহ’ বলে স্বীকার করেন। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ’।

তখন তারা বলে আমাদের দাবির পক্ষে আপনার এ কথাটুকুই যথেষ্ট। তাদের এ দাবি ও কথা যে বাতিল এবং অসত্য তার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে কুরআনের আয়াতের ব্যপারে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দেন যে, কুরআনের আয়াত দু ধরণের। একটি হলো- মোহকাম; অন্যটি হলো মুতাশাবিহ।

– মোহকাম আয়াত
যে সব আয়াতের অর্থ স্পষ্ট কিংবা আয়াতের মর্মার্থ বুঝতে কোনো জটিলতা নেই এবং এতে একাধিক অর্থের সম্ভাবনাও থাকে না। আবার অর্থের জটিলতা থাকলেও প্রিয়নবির বর্ণনায় তা সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।

– মুতাশাবিহ আয়াত
পক্ষান্তরে যেসব আয়াতের অর্থ অস্পষ্ট, কোনো ভাষাবিদ শুধু ভাষা জ্ঞান দ্বারা এর অর্থ নির্ধারণ করতে পারে না তাহলো মুতাশাবিহ। তবে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুতাশাবিহ আয়াতের যদি কোনো ব্যাখ্যা করেন তবে তা মানুষের বোধগম্য হয় এবং সেক্ষেত্রে এ মুতাশাবিহ আয়াতকে ‘মুজমাল’ বল হয়।

প্রিয়নবির সতর্কতা
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়াতের স্পষ্ট ও অস্পষ্টতা সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলে হাদিসে ঘোষণা করেন-
– হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ (সুরা আল-ইমরানের ৭নং) আয়াতটি পাঠ করে বলেছিলেন, যদি তোমরা এমন লোক দেখ যে পবিত্র কুরআনের মুতাশাবিহ আয়াতের পেছনে পড়েছে তখন বুঝে নেবে যে এরাই সেসব লোক যাদের কথা এ আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, আর এমন লোকদের থেকে তোমরা সতর্ক থাকবে।’ (বুখারি)

– হজরত আবু মালেক আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, আমি নিজে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি, আমার উম্মতের ব্যাপারে আমি ৩টি বিষয়ে অত্যন্ত চিন্তিত।

তন্মধ্যে একটি হলো-
কেউ কেউ পবিত্র কুরআন খুলে মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবে। অথচ এ আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা এক আল্লাহ ব্যতিত আর কেউ জানে না।
যারা সত্যিকার জ্ঞানী তারা শুধু এ কথা বলে যে আমরা কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছি। এর সবটুকুই আমাদের মালিক আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আর একথা সর্বজন বিদিত যে শুধু বুদ্ধিমান লোকেরাই নসিহত গ্রহণ করে।

দ্বিতীয়টি হলো-
অধিক পরিমাণে অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া। সম্পদের পরিমাণ নিজেদের পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-কলহ শুরু হবে।

তৃতীয়টি হলো-
মানুষ ইলম বা জ্ঞান অর্জন করে তা বিনষ্ট করে দেবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

সর্বোপরি কথা হলো মানুষের জন্য উপযোগী ও গ্রহণযোগ্য আয়াত হলো ‘আয়াতে মুহকাম’। এ আয়াতের ওপর আমল করার নির্দেশ রয়েছে।

কোনোভাবেই মুতাশাবিহ আয়াত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা উচিত নয়। তবে যেসব মুতাশাবিহ আয়াতের ব্যাপারে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে তার ওপর আমল করা যাবে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তার নির্দেশনা ও সুন্নাতের অনুসরণে যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

প্রকাশ :নভেম্বর ২৪, ২০১৮ ৫:১০ অপরাহ্ণ