আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে সংসদ ভেঙে ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার’ ব্যবস্থা চালু করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ঘোষণা থাকছে। ইশতেহারে আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা থাকছে, তার মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা। এ ছাড়া প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণসহ তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে থাকবে বেশ কিছু চমক। কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে পাঁচ থেকে ১০ ভাগ করবে জোটটি।
এর আগে গত শুক্রবার জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব বিষয়ের কয়েকটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তবে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা ওই সময় কোনো উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ১১ লক্ষ্য এবং বিএনপির ভিশন-২০৩০-কে সামনে রেখেই নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি হচ্ছে। এর আগে নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক ও সিনিয়র নেতারা একটি খসড়া ইশতেহার তৈরি করেছিলেন। এখন ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ জন্য ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি করা হয়েছে। ইশতেহারের খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে প্রতিটি দলের প্রতিনিধি রয়েছেন। প্রতিনিধিরা নিজ নিজ দলের লক্ষ্যগুলোও ইশতেহারের খসড়ায় সংযোজন করছেন। পাশাপাশি সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন সেক্টরের বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের মতামত নিচ্ছেন তারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার চূড়ান্ত করতে কমিটি কাজ করছে। এ মুহূর্তে ইশতেহার যুগোপযোগী হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এ জন্য এখনই বিস্তারিত বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট সংসদ ভেঙে মেয়াদ পূরণের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছিল। ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির মধ্যে প্রধান এ দাবিটি নাচক করে দেন প্রধানমন্ত্রী। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় মেয়াদ পূরণের আগেই নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। অবশ্য দশম সংসদের আগের নির্বাচনগুলো এ পদ্ধতিতে হয়েছে। এ দাবিটি সরকার নাকচ করে দিলেও দশম সংসদ বর্জনকারী তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবার নির্বাচনে যাচ্ছে।
নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে জড়িত ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতা জানান, ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে সংসদ ভেঙে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করবে। তারা যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করছেন, তাতে বিষয়টি রাখা হচ্ছে। সংবিধান মেনেও পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করা সম্ভব। ১২৩ (৩)(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে পরবর্তী সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত রুটিন দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেবেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করে ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। সংসদ ভেঙে দিলে সব দল ও প্রার্থীর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে’র শর্ত পূরণ হবে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে। যে কোনো অজুহাতে রিমান্ডে নেওয়ার বিধানটি সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। প্রশাসনকে দলমুক্ত করা হবে। দলীয় আনুগত্য নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, তরুণদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি ইশতেহারকে যুগোপযোগী করার পরিকল্পনা আছে ঐক্যফ্রন্টের। ইশতেহারের জন্য একটা ভালো স্লোগানও খুঁজছেন তারা। এ জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের নানা দিক তুলে ধরার পাশাপাশি তরুণ ও নারীদের আকৃষ্ট করতে নানামুখী উদ্যোগ থাকছে ইশতেহারে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তিকে। ইশতেহারে প্রতিহিংসা নয়, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে নতুন ধারার রাজনীতির। এসব বিষয়ে ভিশনেও কিছু তথ্য তুলে ধরেছে বিএনপি।
দলের একটি অংশ মনে করে, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় বিএনপি যে ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, তা যুগোপযোগী ছিল না। সেই ইশতেহারে তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো তেমন কোনো উদ্যোগের কথা ছিল না। অন্যদিকে পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে রূপকল্প-২০২১ তুলে ধরে। এতে তরুণরা বেশ আকৃষ্ট হয়। ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায় দলটি।
সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে থাকছে ‘নতুন ধারা’র পূর্ণাঙ্গ ধারণা। সরকার, সংসদ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, কৃষি, পররাষ্ট্রনীতিসহ সরকারের প্রতিটি বিভাগে নতুন ধারার আলোকে পরিকল্পনাগুলো সন্নিবেশিত করা হচ্ছে। মেধার পরিপূর্ণ ব্যবহারের লক্ষ্যে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি কমিয়ে আনা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে দলীয়করণের অবসান ঘটিয়ে মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ঘোষিত ১১ দফা লক্ষ্য ও বিএনপির ভিশন-২০৩০-এর আলোকে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজ চলছে। ইশতেহারে দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক বিষয় থাকবে।
জানা গেছে, হানাহানি, বিভক্তি ও বিভাজনের রাজনীতির অবসান, বিরোধী দলকে সত্যিকার অর্থেই বিকল্প সরকারের মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হবে ইশতেহারে। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা নয়, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সব রাজনৈতিক দলসহ সংশ্নিষ্ট সবার মতামত নিয়েই ঐক্যফ্রন্ট আগামী দিনের রাজনীতি করতে চায়। ইশতেহারে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকবে। শিক্ষা ও কৃষি খাতে যুগোপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা, কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণদান, বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ক্ষেত্রে সহজে ঋণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তাসহ ইতিবাচক সব অঙ্গীকার থাকবে।
সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষিত ১১ লক্ষ্যও ইশতেহারে থাকবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে এ লক্ষ্যগুলো তারা বাস্তবায়ন করবে। লক্ষ্যগুলো হলো- মহান মুক্তিসংগ্রামের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যমান স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থার অবসান করে সুশাসন, ন্যায়ভিত্তিক, শোষণমুক্ত ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা। এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানকল্পে সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। সংশোধন করা হবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাসহ সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগদানের জন্য সাংবিধানিক কমিশন ও সাংবিধানিক কোর্ট গঠন করা হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা হবে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন ও সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হবে। যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সংস্কার করা হবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতিকে কঠোর হাতে দমন করা হবে। দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুব সমাজের সৃজনশীলতাসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে মেধাকে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় কোটা সংস্কার করা হবে।
ইশতেহারে আরও থাকছে, সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চয়তার বিধান করা। জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার সাধন করা; রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক সচ্ছলতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করতে গঠিত কমিটি কাজ শুরু করেছে। প্রত্যেক দলের প্রতিনিধি ওই কমিটিতে আছেন। তারা নিজ নিজ দলের চিন্তাভাবনা ইশতেহারের খসড়ায় তুলে ধরবেন।
জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা থাকছে ইশতেহারে। কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেওয়া; ‘সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’- এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা; বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত ও পুনর্বাসনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।