চলতি বছর জানুয়ারিতে সোলার প্যানেল আমদানিতে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সোলার প্যানেল উৎপাদনে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। পরে ৬ জুলাই ট্রাম্প ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় এমন ৮০০ চীনা পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। এর জবাবে একই রকম ব্যবস্থা নেয় চীন। পরের মাসে উভয় দেশই ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানিতে পাল্টাপাল্টি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে গাড়ি, উড়োজাহাজ, সয়াবিন, কৃষিপণ্য, ইস্পাত, এলুমিনিয়াম প্রভৃতি। প্রকৃতপক্ষে, গত জুলাইয়ে শুল্ক আরোপের শুরু হওয়ার পর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর ’১৮ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার চীনা পণ্যের উপর মোট ২৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করা হল। প্রতিশোধস্বরূপ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করে চীন। চীনের ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র ‘আন্তদেশীয় অর্থনীতিতে সর্বকালের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেবা খাতের মোট রপ্তানির ৩০ শতাংশই বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, চীন তাদের দেশ থেকে বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে গ্রহণ করে বিশ্বে অগ্রসর প্রযুক্তির নেতা হতে চাচ্ছে যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। উল্লেখ্য, চীন দ্রুত তাদের বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদে অগ্রসর থাকার জন্য কাজ করছে। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, চীনের কাছে বাজার খুলে দিয়ে আমেরিকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি এক হিসাব দিয়ে বলেন, ২০১৭ সালে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৮০০ বিলিয়ন বা আশি হাজার কোটি ডলার। আর এ ঘাটতির প্রধান কারণ চীনের সাথে বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীনতা। চীন দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতির সুযোগে ‘অন্যায্য’ভাবে সুবিধা নিচ্ছে বলে তিনি বলেছেন।
চীনের বিরুদ্ধে এ বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার যেমন এটি একটি কারণ তেমন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০১৭ সালের নির্বাচনকালীন স্লোগান ‘আমেরিকাই প্রথম’ এই সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণের জন্য উত্সাহ যুগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দেড়শত বছর ধরে অর্থাৎ ১৮৭২ সাল থেকে বিশ্বে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। অনেকে মনে করছেন, বিশ্ববাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার ধরে রাখার জন্য ট্রাম্প এ নীতি গ্রহণ করেছেন। কারণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পূর্বাভাসে বলছে চীনের যে হারে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এতে খুব শিগগিরি চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যাবে। সর্বশেষ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন-এইচএসবিসি এক প্রতিবেদনে বলা হয় বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আগামী ২০৩০ সালে বর্তমানে শীর্ষ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থানে এবং দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীন শীর্ষে উঠে আসবে।
চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের এক নম্বর ও দুই নম্বর অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে বিশ্ব জুড়ে উদ্বেগ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উত্তেজনা ও ঋণের মাত্রার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে চলতি ও আগামী বছরে বৈশ্বিক পূর্বাভাস হ্রাস করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য বিরোধে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়ায় চলতি ও আগামী বছরের জন্য বৈশ্বিক জিডিপির পুর্বাভাস দুই-দশমাংশ কমিয়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আগামী বছরের প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পাবে। আইএমএফের মতে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিম্নমুখী ঝুঁকি বেড়েছে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বগতির সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে। সংরক্ষণবাদী মনোভাব ক্রমেই বাস্তবতায় পরিণত হতে শুরু করায় ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উত্তেজনাকে বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে মনে করা হচ্ছে। যার মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২৫ হাজার কোটি ডলার সমমূল্যের চীনা পণ্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত ও অন্যান্য পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক আরোপ রয়েছে।
বাণিজ্য বিরোধের কারণে নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় বন্ধ বা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। এতে বিনিয়োগ ও চাহিদা প্রবৃদ্ধি আরো মন্থর হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে সে সাথে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি দুটি পরস্পরের প্রতি বৈরি হয়ে উঠায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে যেখানে সবাইকে কষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস করেছে আইএমএফ যা মন্থর হয়ে আগামী বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে চীনের প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং আগামী বছর ৬ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। আরও বাণিজ্য বাধা আরোপ করা হলে অর্থনীতি, ব্যবসা ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে ব্যাপক আঘাত আসতে পারে। এর ফলে বাণিজ্য নীতির নেতিবাচক প্রভাব কোন কোন দেশের রাজনীতিতেও পড়বে। এ দুই দেশ কোন সমঝোতায় আসতে না পারলে বিশ্ব অর্থনীতি আরও দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যৌথভাবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ।
গত ১১ অক্টোবর ২০১৮ ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে বিশ্বের ১৮৯টি দেশের অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলনে সংস্থা দুটির প্রধান এ উদ্বেগের কথা জানান। তারা বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির বড় দুটি দেশ এভাবে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। তারা আরো বলেন, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এ দুই পরাশক্তি একটি খারাপ উদাহরণ তৈরি করেছে। আর সেটি হবে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বের বাণিজ্য পরিবেশে যে পরিবর্তন আনতে পারে সেসব পরিস্থিতির প্রতি বাংলাদেশকে গভীরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের একক বৃহৎ বাজার যুক্তরাষ্ট্র। রানা প্লাজা ধ্বসের পর থেকেই বাজারটিতে পোশাক রফতানি হ্রাস পায়। দীর্ঘ ১৫ মাস পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ বাজারে পোশাক রফতানি ঘুরে দাঁড়ায়। গত আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) বাজারটিতে ৩৬৬ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করে চীন। অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চীন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ৭০৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানির ৩৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ১ হাজার ৭২৭ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ০৪ শতাংশ কম। রফতানি আয় কমার সঙ্গে চীনের বাজার হিস্যাও কমে ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশ নেমে এসেছে।
Daily Deshjanata দেশ ও জনতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর

