স্বাস্থ্য ডেস্ক:
পানি ছাড়া জীবন একরকম অচল বলা যায়। এছাড়া প্রাকৃতি (natural) পানি ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসার একটা পদ্ধতি হল পানি চিকিৎসা। মেডিকেল পরিভাষায় বলে- watertherapy বা hydrotherapy. পানির মাধ্যমে যে চিকিৎসা তা হল পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম চিকিৎসা। প্রাচীনকালে মানুষ রোগ আরোগ্যের চেষ্টায় সর্বপ্রথম পানিকেই ব্যবহার করতে শুরু করে। পানি চিকিৎসা সবচেয়ে সস্তা আর নিরাপদ। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা বুঝি, পানি যে শুধু আমাদের পরিষ্কার করে তা নয় বরং পানি দিয়ে গোসল করার পর আমরা এক নতুন রকমের সজীবতা ফিরে পাই। এজন্য পানি ক্লান্তি দূরকারী ওষুধ।
বিশুদ্ধ পানি পান: পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করলে রক্ত সঞ্চালন সঠিক, সুন্দর ও স্বাভাবিক হয়। হরমোন গ্রন্থিগুলো ঠিকমত কাজ করে। গোসল করলে যেমন- শরীরের বাহিরটা পরিষ্কার হয়, তেমন প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পান করলেও রক্ত পরিষ্কার হয়। পানি রক্তের বিষাক্ত উপাদান অপসারণ করতে কিডনিকে সাহায্য করে। সঠিক নিয়মে পানি পান করাটাও ওয়াটারথেরাপির আওতায় পড়ে। প্রতিদিন কম্পক্ষে ১০ থেকে ১২ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত।
ঠান্ডা পানি: ঠান্ডা পানির স্পর্শে ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। শরীরে আসে শীতল পরশ।
মৃদু গরম পানি: মৃদু গরম পানিতে গোসল করলে নিদ্রা আনয়ন করে। ব্যথা, খিঁচুনীর তীব্রতা কমায়।
পানি কিভাবে কাজ করে: পানির স্পর্শে স্নায়ু একটা উদ্দীপনা শরীরের গভীরে নিয়ে যায় যার অনুভূতি ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে এবং স্ট্রেস হরমোনকে (stress hormone) নিউট্রাল করে। স্ট্রেস হরমোন শরীরে ক্লান্তির অনুভূতি জাগায়। পানি রক্ত সঞ্চালনকে সজীব করে। হজম ক্রিয়া সুসংহত করে ও ব্যথার অনুভূতি কমায়।
সম্প্রতি এ চিকিৎসা আধুনিক নগরবাসীর মনোবল আকর্ষণ করেছে। প্রাচীন মিসরীয়, পারস্য, গ্রীক, ভারতীয় ও চীনা সভ্যতার মানুষ পানি থেকে চিকিৎসা নিত বলে জানা যায়। খৃস্টপূর্ব ১৫০০ সালে ঋগ্বেদ গ্রন্থে পানি দিয়ে কেমন করে জ্বর থামানো যায় তার বর্ণনা পাওয়া যায়। খৃস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে হিপোক্রিটাস পানি চিকিৎসার সাহায্য নিতেন। তিনি পানি চিকিৎসার বিধান সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা দেন।
পানি প্রয়োগের প্রকারভেদ: রোগের ধরণ অনুযায়ী পানিকে বিভিন্ন উপায়ে রোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়। প্রয়োগ পদ্ধতি অনুযায়ী ওয়াটার থেরাপি প্রধানত ৩টি প্রকার, যথা-
১. বাথ (Bath)
২. ইরিগেশন (Irrigation)
৩. ওয়াটার প্যাক (Water pack)
বাথ (Bath): ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে শরীরে শক্তি সঞ্চয় হয়। রক্ত ও লসিকার সঞ্চালন বাড়ে। কোষের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া বা মেটাবলিজম স্বাভাবিক হয়। বাথটাবে মৃদু গরম পানি নিয়ে তাতে ২০ মিনিট ডুবে থাকলে অন্ত্রের ব্যথা, মাংসের ব্যথা, জোড়াসন্ধির ব্যথা কমে যায়। বাথ কয়েক রকম যেমন-
সিজ বাথ (Sitz bath): একটি গামলায় অর্ধেক পরিমাণ পানি নিয়ে তাতে কাপড় খুলে ২০ মিনিট সময় ধরে নিতম্ব ডুবিয়ে বসে থাকার নাম সিজবাথ। এই পানি ঠান্ডা, গরম বা স্বাভাবিক হতে পারে। যারা অর্শ রোগে ভুগছেন, পায়খানার সাথে রক্ত যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য, পুরাতন পেটের ব্যথা তাদের জন্য সিজ বাথ অনেক উপকার বয়ে আনে। পানিতে নিম তেল মিশালে পাইল্স রোগীর ব্যথা-ফোলা কমে যায়। সন্তান প্রসবের পর মেয়েদের পায়খানার সাথে রক্ত পড়ে। নিম তেল বা ইউক্যালিপ্টাস তেল মিশালে পানিতে সিজ বাথ করলে রক্তপাত বন্ধ হয়। এছাড়া গোসলের পর মলদ্বারে নিম তেল লাগানো যেতে পারে।
ব্রাইন বাথ (Brine bath): লবণ পানির ঘন দ্রবণকে ব্রাইন বলে। গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে সেই পানিতে গোসল করা হয়। গোসল শেষে শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরে। ঘাম ঝরানো অব্যাহত রাখার জন্য গায়ে কম্বল জড়িয়ে রাখতে হয়। অনেক ঘাম ঝরানোর পর যাদের উচ্চ রক্তচাপ তাদের রক্তচাপ বেশ কমে যায়। তিক্ত চর্মরোগ আর অন্থি সন্ধির ব্যথার উপশম হয়। চর্মরোগের জীবাণু আর অস্থিসন্ধির (Joint) জমে থাকা ইউরিক এসিড ঘামের সাথে চলে যায়।
ওয়ার্লপুল (Whirlpool): পুরাতন বাত রোগীর ব্যথা কমাতে ও রোগীকে একটু স্বস্তির পরশ দিতে ওয়ার্লপুল থেরাপির সাহায্য নেয়া হয়। এটা আর কিছু নয় বাথটাবের পানিতে ফ্যান লাগিয়ে স্রোত তৈরি করা হয়। রোগী এই স্রোতে কিছু সময় অবস্থান করলে ব্যথা কমে যায়।
হারবাল বাথ (Harbal bath): বাথ টাব মৃদু গরম পানিতে পূর্ণ করে সেই পানিতে কিছু ভেষজ উপাদান মিশিয়ে গোসল করলে হারবাল বাথ হয়ে যায়। এই পানিতে লেবুর ছাল, পুদিনা পাতা, গোলাপ ফুল মিশালে আপনার ক্লান্তি দ্রুত চলে যাবে। মনে প্রফুল্ল ভাব আসবে। পানিতে ইউক্যালিপ্টাস তেল, তুলসী পাতা মিশালে ঠান্ডা কাশি ভাল হয়ে যায়। হাঁপানী বা শ্বাসকষ্ট কম হয়।
ফুটবাথ (Footbath): গামলা ভর্তি পানিতে দুই পা কিছু সময় ডুবিয়ে রাখার নাম ফুটবাথ। যাদের পায়ের শিরা ফুলে যায়, পা ঘামে, মোজায় গন্ধ হয় তারা ঠান্ডা পানিতে ফুটবাথ নিলে এ সমস্যাগুলো চলে যায়। অনেকের পা সব সময় ঠান্ডা থাকে, সামান্য ঠান্ডা আবহাওয়ায় পা ঠান্ডায় জমে যায়, হাঁটতে কষ্ট হয়। এ সব রোগের কোন ঔষধ নেই। অথচ গরম পানিতে ফুটবাথ করলে খুব সহজে এ সমস্যাগুলো চলে যায়। ঔষধ ছাড়াই মেলে চিকিৎসা।
ইরিগেশন (Irrigation): দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গে পানির প্রবাহধারা দেয়াকে ইরিগেশন বলে। যেমন-ইনেমা (Enema)-মলদ্বারের ভিতর পানির ধারা প্রবেশ করানোকে ইনেমা বলে। একটি চিকন পানির পাইপ মলাশয়ে প্রবেশ করানো হয়। তারপর ট্যাপে চাপ দিলেই অন্ত্রের ভিতর প্রায় ৮ ইঞ্চি জায়গা পরিমাণ পানি ঢুকে যায়। অন্ত্রনালীতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা শক্ত মল অপসারণে এর চাইতে ফলপ্রসু আর কোন পদ্ধতি নাই। ডায়রিয়া হলে শীতল পানির ধারা দিলে অন্ত্রের তাপ কমে যায়। জ্বালাপোড়া থেমে যায়। পেটের কামড়ানি, খিঁচুনিসহ যাবতীয় সমস্যায় উপকার বয়ে আনে। এই পানির সাথে নিম তেল (Neem Oil) মিশালে পাইলস বা অর্শ রোগ সেরে যায়।
ন্যাসাল ইরিগেশন (Nasal Irrigation): বিশেষ নিয়মে গরম পানি নাকের ভিতর চালনা করা হয়। এটি সাইনোসাইটিস এবং ঊর্ধ্ব শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিরসন করে।
ভ্যাজাইনাল ইরিগেশন (Vaginal irrigation): অনেক সময় মাসিক হওয়ার পরেও যোনীপথের ভিতর রক্তের কিছু দাগ থেকেই যায়। পাইপের মাধ্যমে কিছু মৃদু গরম পানি দিলে সব রক্ত ময়লা নিমিষে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়। জরায়ুর ভিতর ফোলা, প্রদাহ হলে ঠান্ডা পানি দিতে হয়।
ওয়াটার প্যাক (Water pack): রাবারের প্যাকে গরম বা ঠান্ডা পানি ভর্তি করে দেহের বিভিন্ন স্থানে পরশ দেওয়া হয়। যেমন-
গলা- গরম পানি ভর্তি ব্যাগ গলায় রাখলে গলার যে কর্কশ ভাব তা চলে যায়। এছাড়া স্বরযন্ত্রের প্রদাহ, খাদ্যনালীর প্রদাহ, টনসিলের প্রদাহ সেরে যায়। চীনা চিকিৎসকগণ দাবী করেন, নিয়মিত গলায় গরম পানির স্পর্শ দিলে হাইপোথাইরয়েডিজম, হাইপার থাইরয়েডিজমের মত জটিল রোগেরও উপশম হতে পারে।
বুক -একইভাবে বুকে গরম পানির ব্যাগ রাখলে কষ্টকর শ্বাসটান সমস্যার উপশম হয়। ফুসফুসের কোষকলা ইলাস্টিসিটি (Elasticity) হারিয়ে ফেললে এমন সমস্যা হয়। ফুসফুসেরর ইলাস্টিসিটি ফিরিয়ে আনার জন্য কোন ডাক্তারী ঔষধ নেই। অথচ বুকে নিয়মিত গরম পানি স্পর্শে হারানো ইলাস্টিসিটি ফিরে আসতে পারে।
পেট -পেটের উপর গরম পানি ভর্তি ব্যাগ রাখলে পেটফাঁপা, বদহজম, অম্লাধিক্য, যকৃতের প্রদাহে উপকার হয়।
কুলিং প্যাক (Cooling pack)-যখন কোথাও ফোলা বা প্রদাহ হয় এবং ত্বক লালচে হয় তখন রাবারের ব্যাগে বরফ কুচি ভরে লাগালে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। ব্যথা কমে যায়। লালভাব দূর হয়।
বিশ্বব্যাপী গবেষণা কার্যক্রম
জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষাঘাত পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের গবেষকবৃন্দ ২২ জন এ্যাজমা রোগী নির্বাচন করেন। এদের বয়স ছিল গড়ে ৭০ বছর। তাদেরকে মৃদু গরম পানি ভর্তি বাথটাবে এক্সারসাইজ করানো হয়। ২ মাস পর দেখা গেল তাদের প্রত্যেকের শ্বাসকষ্ট লাঘব হয়েছে। এ্যাজমাজনিত কষ্ট থেকে সবাই কমবেশী আরাম বোধ করেছে। যে সকল এ্যাজমা রোগীকে এই পানি চিকিৎসার আওতায় আনা হয় নাই তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয় নাই।
সুইডেনের মামলমো জেনারেল হাসপাতালের গবেষখবৃন্দ এমন কিছু রোগীর উপর গবেষণা পরিচালনা করেন যারা পায়ের দুর্বলতার কারণে হাঁটা চলাফেরা করতে অক্ষম ছিল। রোগীদেরকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে একবার ঠান্ডা আবার একবার গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখতে বলা হয়। প্রায় ৪ মাস চিকিৎসার পর রোগীদের চলাফেরার উন্নতি হয়। ব্যথা কমে যায়, পায়ের পাতা, গোড়ালি ও আঙ্গুলে রক্ত সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। উচ্চ রক্তচাপ কিছুটা হলেও কমে যায়। তবে এই উপকারিতা ১ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।