ক্রীড়া ডেস্ক:
সাকিব আল হাসান নেই, নেই তামিম ইকবাল। ইনজুরি নিয়ে খেলছেন মুশফিকুর রহীম এবং অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। দলের নিউক্লিয়াস যারা, তাদেরই অধিকাংশ নেই কিংবা ইনজুরি আক্রান্ত। এমন একটি দল নিয়েই এশিয়া কাপের ফাইনালে পৌঁছে গেলো বাংলাদেশ।
আবু ধাবির শেখ জায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে ৩৭ রানে হারিয়ে দিয়ে টানা দ্বিতীয়বার এবং এ নিয়ে তৃতীয়বার ফাইনালে উঠলো বাংলাদেশ। ২০১২ সালে প্রথম। ২০১৬ সালের পর ২০১৮ সালে টানা দ্বিতীয় বার। এর মধ্যে ২০১৬ ছিল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের।
বাংলাদেশের ছুঁড়ে দেয়া ২৪০ রানের জবাব দিতে নেমে পাকিস্তান থমকে গেলো মাত্র ২০২ রানে। হারিয়েছে ৯ উইকেট হারিয়েছে। মোস্তাফিজুর রহমান দুর্দান্ত বোলিং করলেন। ৪৩ রান নিয়ে ২ উইকেট নিয়েছেন তিনি। দুটি ক্যাচ মিস না হলে নিশ্চিত, তার উইকেট আরও বাড়তো।
২ উইকেট নিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ, ২৮ রান দিয়ে। ১টি করে উইকেট নিয়েছেন রুবেল হোসেন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং সৌম্য সরকার। উইকেটশূন্য ছিলেন কেবল মাশরাফি। কিন্তু দুটি ক্যাচ ধরে দলের জয়ে তো অন্যতম সেরা অবদান তারও। সঙ্গে নেতৃত্ব ছিল তার অসাধারণ। মাশরাফির দুর্দান্ত নেতৃত্বের কারণেই ২০২ রানে পাকিস্তানকে বেধে রাখা সম্ভব হলো।
পাকিস্তানের ওপেনার ইমাম-উল হক একাই লড়াই করলেন। তিনি খেলেছেন ৮৩ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস। তবে বাংলাদেশের বোলারদের সাঁড়াসি বোলিংয়ের সামনে এই ইনিংস আর খুব একটা কাজে লাগলো না। পাকিস্তানের পরাজয় ঠেকাতে পারেনি।
উইকেটের পেছনে লিটন দুটি ক্যাচ মিস করাছাড়া বাংলাদেশের ফিল্ডিং ছিল দুর্দান্ত। ব্যাটিং-বোলিংয়ের সঙ্গে ফিল্ডিংও বাংলাদেশের সঙ্গে দারুণ একটা পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। ম্যাচ শেষে আলাদা করে ফিল্ডিংয়েরও প্রশংসা করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।
শুরু থেকেই মিরাজ-মোস্তাফিজদের বোলিং আক্রমণে দিশেহারা অবস্থা হয় পাকিস্তানের। প্রথম ওভারেই মিরাজের ঘূর্ণিতে বিভ্রান্ত হয়ে উইকেট হারান ওপেনার ফাখর জামান। রুবেল হোসেনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান তিনি। পরের ওভারেই মোস্তাফিজের আক্রমণ। ৪ ওভারের মধ্যেই ৩ উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যায় পাকিস্তান। সেখান থেকে ইমাম-উল হক, শোয়েব মালিক, আসিফ আলিদের মাঝারি ধরনের কয়েকটা ইনিংস পাকিস্তানকে লড়াকু পজিশনে নিয়ে আসে।
মূলতঃ শুরু থেকেই দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিং উপহার দেয় বোলাররা। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রত্যাশামাফিক সংগ্রহ স্কোরবোর্ডে জমা করতে না পারলেও, বোলিংয়ে যেমন শুরুর প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমনটাই এনে দিলেন ডানহাতি অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ ও বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। ইনিংসের প্রথম এবং দ্বিতীয় ওভারেই সাজঘরের পথ দেখিয়েছেন দুই পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানকে।
বাংলাদেশের করা ২৩৯ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের পঞ্চম বলেই মেহেদি হাসান মিরাজের বোলিংয়ে মিড অনে দাঁড়ানো রুবেল হোসেনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন ফাখর জামান। ৪ বল খেলে মাত্র ১ রান করতে পেরেছেন তিনি।
পরের ওভারের দ্বিতীয় বলেই পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজমকে সাজঘরের ঠিকানা দেখান মোস্তাফিজ। বাঁহাতি কাটার মাস্টারের মিডল স্টাম্পে পিচ করা ডেলিভারিতে লিগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন বাবর। আউট হওয়ার আগে ৩ বল খেলে ১ রান করতে পেরেছেন বাবর।
বোলারদের সঙ্গে উইকেটের পেছনে মুশফিকও ছিলেন দুর্বার। তিনি যে অবিশ্বাস্য ক্যাচ ধরলেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। মোস্তাফিজের বলে তার ঝাঁপিয়ে পড়া ধরা ক্যাচেই ফিরে গেলেন পাকিস্তান অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। মাত্র ১৮ রানেই পড়লো পাকিস্তানের তৃতীয় উইকেট।
চতুর্থ ওভারের তৃতীয় বলটি অফ কাটার দেন মোস্তাফিজ। ভেতরের দিকে পড়ে বেরিয়ে যেতেই শট খেলতে যান সরফরাজ। কিন্তু বল ব্যাটে হালকা চুমু দিয়ে সোজা প্রথম স্লিপ দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগছিল। কিন্তু ডান পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই বলটি তালুবন্দী করে নিলেন মুশফিক। ৭ বলে ১০ রান করে ফিরে গেলেন সরফরাজ। সতীর্থরা এসে মুশফিককে শোয়া থেকে তুলে জড়িয়ে ধরলেন। কোমরে ব্যাথা নিয়েও যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি, সেটাই অবিশ্বাস্য।
১৮ রানে নেই তিন উইকেট। সেখান থেকে পাকিস্তান ইনিংসের হাল ধরেন শোয়েব মালিক এবং ইমাম-উল হক। এই জুটি ভাঙতে নিরন্তর চেষ্টা বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার। কোনোভাবেই পারছিলেন না। একটার পর একটা বোলার পরিবর্তন করেও না। এরই মধ্যে ৬৭ রানের জুটি গড়ে ফেলেন দুই পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান।
২১তম ওভারে রুবেলের হাতেই বল তুলে দিলেন মাশরাফি। ওভারের প্রথম বলেই মিডল স্ট্যাম্পের ওপর রাখেন রুবেল। ফুল লেন্থের। শোয়েব মালিক চেষ্টা করেন মিডউইকেটের ওপর দিয়ে বলটা তুলে দিতে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন মাশরাফি। মাথার ওপর দিয়ে বলটা চলে যাচ্ছিল। খানিটা পেছনদিকে লাফ দিয়ে মাথার পেছনে হাত বাড়িয়ে দুরহ কোন থেকে ক্যাচটা তালুবন্দী করলেন তিনি।
দুর্দান্ত এক ক্যাচ। তার এই ক্যাচেই ৩০ রানে বিপজ্জনক হয়ে ওঠা শোয়েব মালিককে ফিরলেন সাজঘরে। ৫১ বলে ৩০ রান করেন শোয়েব মালিক। তবে আঙ্গুলে ব্যাথা পেয়ে এ সময় মাঠ ছেড়ে যান মাশরাফি। মাশরাফির আগে দুর্দান্ত এক ক্যাচ ধরেছিলেন মুশফিক। তার ক্যাচে ফিরেছিলেন সরফরাজ আহমেদ।
শাদাব খানকে পাঠানো হয় উইকেট ধরে রেখে রানের চাকা সচল রাখার জন্য। কিন্তু অকেশনাল বোলার সৌম্য সরকারের করার ২৬তম ওভারের প্রথম বলে লেগ সাইডের বল ব্যাটে লাগিয়ে জমা দেন উইকেটরক্ষক লিটন দাসের হাতে। ৪ রান করে ফিরে যান সাদাব খান।
৯৪ রানে ৫ উইকেট পড়ার পর ইমাম-উল হক এবং আসিফ আলি মিলে আরও একটি দারুণ জুটি গড়ে তোলেন। তাদের দু’জনের ব্যাট থেকে আসে ৬৯ রানের জুটি। এরই মধ্যে মোস্তাফিজের বলে সহজ একটি ক্যাচ মিস করেন লিটন কুমার দাস।
৩৪তম ওভারে বল তুলে দেয়া হয়েছিল মোস্তাফিজের বলে। প্রথম বলেই আসিফ আলিকে কাটার দিলেন বাংলাদেশের এই পেসার। ব্যাটের কানায় লাগিয়ে দিলেন আসিফ আলি। কিন্তু উইকেটের পেছনে মনযোগি ছিলেন না ভারপ্রাপ্ত কিপার লিটন কুমার দাস। মুশফিক অস্বস্তি নিয়ে মাঠ ছেড়ে যান। ফলে কিপিংয়ের দায়িত্বে আসেন লিটন।
আসিফ আলির ব্যাট ছুঁয়ে আসা বলটা শেষ মুহূর্তে একহাত ধরতে যান লিটন। কিন্তু সেটা আর হাতে জমাতে পারেননি। ছেড়ে দেন। সহজ ক্যাচ ছেড়ে দিয়ে নিশ্চয় অনুশোচনায় পুড়ছিলেন লিটন। দর্শক-সমর্থকরাও দুয়ো ধ্বনি দিচ্ছিল তার নামে।
অবশেষে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্য করার সুযোগ পেলেন তিনি। পর পর দুই ওভারে পাকিস্তানের সেট হওয়া দুই ব্যাটসম্যান আসিফ আলি এবং ইমাম-উল হককে স্ট্যাম্পিং করে ক্ষত পুষিয়ে দিলেন তিনি।
৪০তম ওভারে মেহেদী হাসান মিরাজের হালকা সুইং করা বলে এগিয়ে এসে খেলতে যান আসিফ আলি। কিন্তু তিনি মিস করেন। চোখের পলকে বল ধরে স্ট্যাম্প ভেঙে দেন লিটন। ৪৭ বলে ৩১ রান করে ফিরে যান আসিফ আলি। পরের ওভারে বোলার ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ওভারের পঞ্চম বলে তাকে এগিয়ে এসে খেলতে যান ইমাম উল হক। যিনি ততক্ষণে ৮৩ রান করে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন।
মাহমুদউল্লাহর বলটি মিস করলেন ইমাম। পেছন ফিরেই দেখেন তার স্ট্যাম্প উড়ে গেছে। অর্থ্যাৎ, এবার বল ধরে চোখের পলকে স্ট্যাম্প ভেঙে দিলেন লিটন। ১০৫ বলে ৮৩ রান করে ফিরে গেলেন পাকিস্তানের এই ওপেনার। বাংলাদেশের জয়ও প্রায় হাতের মুঠোয় চলে এলো।
ইমাম-উল হক আউট হওয়ার পর শুধু আনুষ্ঠানিকতার পালা। পরের টানা দুটি উইকেট তুলে নেন মোস্তাফিজুর রহমান। মোহাম্মদ নওয়াজ ৮ রান করার পর তার বলে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ মিডউইকেটে নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে ক্যাচ দেন। তার আগে হাসান আলিও উুঁচু করে মারতে গিয়ে আউট হলেন মাশরাফির হাতে ক্যাচ দিয়ে। তিনিও করেন ৮ রান।
তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান খেলা শেষ ওভারে নিয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে শাহিন আফ্রিদি মাঠে নেমে ১৪ রান করে অপরাজিত থাকেন। তার সঙ্গে অপরাজিত ছিলেন জুনায়েদ খান, ৩ রানে। যদিও এর মাঝে মোস্তাফিজের বলে আরও একটি ক্যাচ মিস করেন লিটন কুমার দাস। তবে এটা একটু কঠিনই ছিল।
এর আগে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ৪৮.৫ ওভারে ২৩৯ রানে অলআউট হয়েছে বাংলাদেশ। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৯৯ রান করেছেন মুশফিক। মিঠুনের ব্যাট থেকে এসেছে ৬০ রানের ইনিংস।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ : ২৩৯/১০, ৪৮.৫ ওভার (মুশফিকুর রহীম ৯৯, মোহাম্মদ মিঠুন ৬০, মাহমুদউল্লাহ ২৫, মাশরাফি ১৩, মেহেদী হাসান মিরাজ ১২, ইমরুল কায়েস ৯, লিটন দাস ৬, মুমিনুল হক ৫, রুবেল ১, সৌম্য সরকার ০, মোস্তাফিজ ০*; জুনায়েদ খান ৪/১৯, শাহিন আফ্রিদি ২/৪৭, হাসান আলি ২/৬০, শাদাব খান ১/৫২)।
পাকিস্তান : ২০২/৯, ৫০ ওভার (ইমাম-উল হক ৮৩, আসিফ আলি ৩১, শোয়েব মালিক ৩০, শাহিন আফ্রিদি ১৪, মোহাম্মদ নওয়াজ ৮, হাসান আলি ৮, সরফরাজ ১০; মোস্তাফিজুর রহমান ৪/৪৩, মেহেদী হাসান মিরাজ ২/২৮, রুবেল হোসেন ১/৩৮, মাহমুদউল্লাহ ১/৩৮, সৌম্য সরকার ১/১৯)।
ফল : বাংলাদেশ ৩৭ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : মুশফিকুর রহীম।