তুষার আবদুল্লাহ:
মন খারাপের সময় যাচ্ছে। অথচ প্রকৃতি উৎফুল্ল করে রাখার মতো সাজগোজ করে আছে। ভাদ্রের উষ্ণতাকে ম্লান করে দেয় নীল আসমানে রৌদ্রের খিলখিল হাসি। কখনো কখনো শীতল বাতাস গোলাপজল পরিমাণ জল ঝরে পড়ছে মেঘ থেকে। তারপরও প্রাণখুলে হাসা যাচ্ছে না। কাষ্ঠ হাসি হাসতে হচ্ছে। মনের এই আবহাওয়ার শুরু এবারের ভাদ্রতেই নয়।
কয়েক ঋতু ধরেই এমন আছি। আমরা যেখানে যে পেশায় আছি সেখানে স্বস্তি পাচ্ছিনা। কাজে গতি নেই। দৃশ্যমান অর্থে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের উৎপাদন বাড়ছে। আবিষ্কার হচ্ছে বিপণনের নতুন নতুন কৌশল। বাজার ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে চলে গেছে বহু আগেই। এখন সেই বাজারে নতুন পণ্য যোগ হচ্ছে। উৎপাদনখাতের বাইরে সম্প্রসারিত হচ্ছে সেবা খাত। এই খাতে বিনিয়োগ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ভোক্তা।
‘মান কমেছে শিক্ষকেরও। শিক্ষক তৈরির জন্য রাষ্ট্র বিনিয়োগ করেনি। ফলে মেধাবী বা দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি যে শিক্ষাব্যবস্থায়, সেখানে দক্ষ কর্মী পাওয়ার সুযোগ নেই। মনখারাপের কারন হলো, এই বিপর্যয়ের পরেও যখন দেখছি শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়লেও, নজর দেয়া হচ্ছেনা সুষম পাঠ্যক্রম তৈরির দিকে। মেধা যাচাই প্রক্রিয়াটিও বিতর্কমুক্ত হচ্ছে না। ’
সার্বিক দৃশ্যমান সূচক ভালো। কিন্তু মন খারাপ হয়ে যায় ভেতরে উঁকি দিলে। আমরা দেখতে পাচ্ছি দক্ষ কর্মীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কর্মী বা শ্রমিকের দক্ষতা কমে গেছে একথা বলা যাবে না। সেখানে অদক্ষ, আধাদক্ষ এবং দক্ষ শ্রমিকরা যেভাবে শ্রম দিতেন তেমন ভাবেই দিচ্ছেন। তাদের মজুরি বাড়ালে আরো গুণগত মান বাড়তে পারে। কিন্তু কমছে উৎপাদনের ব্যবস্থাপনা ও সেবা খাত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মীর দক্ষতা।
বাহ্যিক ভাবে দেখা যাবে- দুই দশ আগের চেয়ে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে পেশাসহায়ক বা শ্রমবাজারমুখি নানা বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক, ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করা চাকরি প্রার্থীর অভাব নেই। কিন্তু এই সনদধারীরা শ্রমবাজারে ঢুকে কাঙ্খিত দক্ষতা দেখাতে পারছে না।
সেবা ও উৎপাদখাত যেমন কুশলী কর্মীর খোঁজ করছে, তেমন কর্মি সনদধারীদের মধ্য থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা। ফলে উদ্যোক্তাদের তাদের ব্যবসার গুণগতমান ও বিপণন আধিপত্য ধরে রাখার জন্য জনবল আমদানী করে আনতে হচ্ছে।
এখানে কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য একথাও সত্য, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বা খাত স্থানীয় দক্ষ কর্মী থাকার পরেও তাদের উপর ইচ্ছে করেই ভরসা রাখছে না তবে সার্বিক সত্য হলো দক্ষ কর্মীর ঘাটতি। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্র সকল ক্ষেত্রে এখন এই কথা স্বীকার করেই নেয়া হচ্ছে , উচ্চশিক্ষা থেকে নানাবিধ শিক্ষার বাণিজ্যিক প্রসার ঘটলেও, মেধাবী কর্মী মিলছে না।
কেন মিলছেনা? ফলাফল তো ভালো। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা ভাল ফল নিয়েই বের হচ্ছে। সমস্যা রয়ে গেছে পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে। দফায় দফায় পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করতে গিয়ে এর মান নিম্নমুখি হয়েছে। পাশের বাম্পার হার দেখাতে গিয়ে কম মেধাবীদের মেধার মোড়কে পুরে ছাড়া হয়েছে বাজারে। আর উচ্চশিক্ষাতো এখন নগদ মূল্যে যে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুলভ।
মান কমেছে শিক্ষকেরও। শিক্ষক তৈরির জন্য রাষ্ট্র বিনিয়োগ করেনি। ফলে মেধাবী বা দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি যে শিক্ষাব্যবস্থায়, সেখানে দক্ষ কর্মী পাওয়ার সুযোগ নেই। মনখারাপের কারন হলো, এই বিপর্যয়ের পরেও যখন দেখছি শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়লেও, নজর দেয়া হচ্ছেনা সুষম পাঠ্যক্রম তৈরির দিকে। মেধা যাচাই প্রক্রিয়াটিও বিতর্কমুক্ত হচ্ছে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোগ চাকরির পরীক্ষা অবধি পৌঁছে গেছে। আর দক্ষ শিক্ষকেরা বিদায় নিচ্ছেন কিন্তু তাদের শূন্যস্থান পূরণের কোন উদ্যোগ নেই। সর্বোপরি বিদ্যায়তন ও সমাজ পাঠ বিমুখ হয়ে পড়ছে। জ্ঞানের বদলে আসক্ত হচ্ছে উপাত্ত বা তথ্যে। জ্ঞান চ্যুত কোন সমাজের পক্ষেই সৃজনশীল ও দক্ষ কর্মী উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ এই উৎপাদনে দক্ষতা বাড়ানোর কাজে এখনও আলসে। তাই মন ভালো হবার সুযোগ নেই এই বাজার অর্থনীতির কালে।
লেখক : হেড অব নিউজ, সময় টিভি।