নিজস্ব প্রতিবেদক:
মহাসড়কে লেগুনা চলাচলের কারণে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ আগস্ট সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় লেগুনা চলাচলে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ঢাকা মহানগর পুলিশ গত মঙ্গলবার লেগুনা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এতে মঙ্গলবার রাত থেকে রাজধানীর প্রায় ২০০ রুটে লেগুনা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
গতকাল বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, গাবতলী, কল্যাণপুর, মিরপুর-১ নম্বর ঘুরে দেখা গেছে সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সবার কণ্ঠেই শোনা গেছে ক্ষোভের কথা।
গতকাল বিকেলে কল্যাণপুরে দেখা গেছে শত শত যাত্রী লেগুনার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু লেগুনা নেই। দুপুর ১টার দিকে গুলিস্তানের কাপ্তানবাজার এলাকায় দেখা গেছে, সেখানে একটিও লেগুনা নেই। অন্য দিন সেখানে অন্তত অর্ধশত লেগুনা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, মগবাজার, বাড্ডা এলাকায় দেখা গেছে অন্য দিনের তুলনায় বাসের সংখ্যাও কম। বাসচালক ও হেলপাররা জানায়, পুলিশের অভিযানের ভয়ে অনেকে পুরনো গাড়ি নামায়নি। বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশকে গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করতে দেখা গেছে।
লেগুনা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সচিব) মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘লেগুনা অবৈধ গাড়ি। মাইক্রোবাস কেটে এগুলো বানানো হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলোর কারখানা আছে। বহু আগেই এগুলো সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়েছে। মানুষের প্রাণ বাঁচাতেই মহাসড়কে এগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কঠিন সিদ্ধান্তের কারণে জনগণকে একটু দুর্ভোগ মেনে নিতে হবে। এতে অবৈধতা প্রাণনাশের কারণ হবে না।’ সময় বেঁধে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল—এমন মতামতের বিষয়ে তিনি বলেন, আগে বহুবার সময় দেওয়া হয়েছিল। কোনো ফল হয়নি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘লেগুনাকে ঢাকার উপসড়কে চলতে দিতে হবে। কারণ বিভিন্ন অলিগলি পর্যন্ত লেগুনা ঢুকতে পারে। বাস বা মিনিবাসের মাধ্যমে সেভাবে যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হয় না। বাসের বিকল্প হিসেবে এ ধরনের বাহন ঢাকার মিরপুর থেকে গুলশান, মহাখালী, মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর, ফার্মগেট থেকে নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন রুটে যাত্রী পরিবহন করত। যেখানে বাসে যাত্রীদের ঠেলে নারীরা উঠতে পারত না, সেখানে লেগুনায় তারা উঠতে পারত।’
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের মতে, ‘লেগুনা হঠাৎ করে নিষিদ্ধ হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন। মানুষ বিকল্প বাহনের অভাবে বড় বেশি দুর্ভোগে পড়বে। আমরা লেগুনা চলাচল বন্ধের পক্ষেই। তা বন্ধ করার আগে যাতায়াতের বিকল্প বাহনের ব্যবস্থা দরকার। রুট ফ্রাঞ্চাইজির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কম্পানির আওতায় গণপরিবহন নিশ্চিত করা জরুরি।’ বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে হঠাৎ করে লেগুনা বন্ধে বিপর্যয় নেমে এসেছে মন্তব্য করে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অংশীজনদের মতামত না নিয়ে এভাবে হুট করে আগেও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে তা বেশিদিন টেকেনি।’
দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে কৃতিত্ব নিতে বা চাপে পড়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে। অথচ পুলিশের চোখের সামনেই এত দিন এ ধরনের বাহন চলেছে। পুলিশের পরিবহন চাহিদাও মেটাচ্ছে লেগুনা।’
তবে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান মো. মশিয়ার রহমানের মতে, পুলিশ যদি লেগুনা বন্ধ করতে চায় করুক। গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা এ উদ্যোগ নিতেই পারে।
ঢাকার পরিবহন নেতা ও যাত্রীরা জানান, ২০০২ সালে টেম্পোর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পরিবেশবান্ধব হিসেবেই লেগুনা (হিউম্যান হলার) চলাচল শুরু করে। ঢাকা মহানগরীতে আরটিসি প্রায় ১৫৯টি রুটে এ ধরনের গাড়ি চলাচলের অনুমোদন দেয়। তবে অনুমোদনের বাইরেও আরো ৪১টি রুটে লেগুনা চলাচল করছিল।
বাংলাদেশ অটোরিকশা অটো টেম্পো পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকায় চলাচলরত লেগুনা বা হিউম্যান হলার পূর্বঘোষণা ছাড়াই চলাচল বন্ধের ফরমান জারি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার। তিনি মেট্রো আরটিসির চেয়ারম্যানও। হঠাৎ এ সিদ্ধান্তে পরিবহন খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এটা হঠকারী সিদ্ধান্ত। আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পুলিশ প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নিতে পারত।’
বাংলাদেশ অটোরিকশা অটো টেম্পো পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমণ্ডির বাসায় গিয়ে জানতে চেয়েছি কেন হঠাৎ পূর্বঘোষণা ছাড়াই লেগুনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হলো। আমরা দুই হাজার চালক ও মালিক সেখানে উপস্থিত হই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে আমাদের সংগঠনের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত ও যুগ্ম কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ভিআইপি সড়ক বাদ দিয়ে ফিডার রোডে লেগুনা চলতে পারবে। তবে পুলিশি আতঙ্কে চালকরা রাস্তায় বের হচ্ছে না।’
এদিকে, গতকাল সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বেশ তৎপরতা দেখা গেছে। দুপুরে মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকায় রোভার স্কাউটদের যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। রোভার স্কাউটদের কয়েকজন জানায়, সড়কে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। মতিঝিলে বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে ফুটপাতের দোকানকে দায়ী করে তারা।
তবে বাসচালক ও হেলপারদের বক্তব্য অন্য রকম। ১৫ নম্বর বাসের এক চালক রাশেদ জানান, তাঁরা যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত বাস চালান। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা সোনালী ব্যাংকের পাশে রাস্তায় বাস থামানোর কারণে সেটিই স্টপেজ হিসেবে গণ্য হয়ে গেছে। নতুন করে স্টপেজ করায় যাত্রীদের পাশাপাশি তাঁদেরও সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা ঠিকমতো বুঝতেই পারছেন না আসলে স্টপেজ কোনটা। ফলে আগে যেখানে যেখানে বাস থামাতেন, সেখানে সেখানেই থামানোর চেষ্টা করেন।