স্বাস্থ্য ডেস্ক:
মানুষ সমাজে নানা নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ছকে বাঁধা তার দৈনিক জীবন যাপন। তবুও মানুষ এই নিয়মের শৃঙ্খল ছিন্ন করে একটু ভিন্ন আমেজের অভিপ্রায়ে, অজানাকে জানতে, অদেখাকে দেখতে, অশুনাকে শুনতে লোকালয়ের বাইরে দূরে কোনো অরণ্য, বন, নদী, প্রাচীন স্থাপত্য, সংরক্ষিত পার্ক প্রভৃতির উদ্দেশে পা বাড়ায়। এ সময়ে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। অথচ একটু সচেতন হলেই ভ্রমণের সাথে কিছু স্বাস্থ্যসম্মত পন্থা অনুসরণের মাধ্যমে তা হয়ে উঠতে পারে আরো আনন্দময় ও ঝামেলাবিহীন। এড়ানো যেতে পারে নানা রোগসহ বিপজ্জনক দুর্ঘটনা।
চাই ভ্রমণপূর্ব সঠিক প্রস্তুতি:
ভ্রমণের আগে নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্রের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ম্যালেরিয়া প্রতিরোধকল্পে প্রয়োজনীয় ওষুধ ভ্রমণের শেষ দিন পর্যন্ত প্রয়োজনে অতিরিক্ত দুই-তিন দিনের জন্য সঠিক মাত্রায় উপযুক্ত পরিমাণ ওষুধ নিয়ে নিন। নিয়মিত ওষুধ সেবন নিশ্চিত করুণ। তা ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কিছু বহুল ব্যবহৃত ওষুধ যেমন : জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্য খাবার স্যালাইন নিতে ভুলবেন না। সাথে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টার কিংবা সম্ভব হলে সহজেই বহনযোগ্য পানি বিশুদ্ধকরণ ফিল্টার, সমুদ্রের বেলাভূমিতে সূর্যের অতিরিক্ত আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় সানগ্লাস ও সানব্লক, পতঙ্গের বিশেষত মশার দংশন থেকে রক্ষা পেতে কীটনাশকযুক্ত মশারি, কীটনাশক স্প্রে, শরীর ঢেকে রাখার জন্য লম্বা হাতাওয়ালা পাতলা শার্ট, লম্বা পেন্ট, লম্বা হাত ও পায়ের মুজা, বাইরে পরিধানের জন্য প্রয়োজনীয় টুপি নিন।
নিশ্চিত করুন নিরাপদ খাবার পানীয়:
খাবারের আগে ও পরে হাত ভালো করে সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। শুধু বোতলজাত ফিল্টার পানি বা সম্ভব না হলে অন্তত ফুটানো পানি পান করুন। রাস্তার খোলা খাবার, পানি, ঝরনার পানি, স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত আইসক্রিম ও বরফমিশ্রিত খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন। পাস্তুরিত না হলে দুধ খাবেন না। শুধু ভালোভাবে সেদ্ধ স্বাস্থ্যসম্মত বিশুদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। এড়িয়ে চলুন সালাদ জাতীয় কাঁচা খাবার। এতে পাতলা পায়খানা বা আমাশয়, হেপাটাইটিস-এ প্রভৃতি রোগের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
এড়িয়ে চলুন দুর্ঘটনা:
মদ ও অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ ও পথ চেনা জানা না হলে নিজে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন। গাড়িতে চলাচলের সময় সিটবেল্ট কিংবা মোটর গাড়ি বা বাইক ব্যবহারের সময় মাথায় হেলমেট ব্যবহার করুন। কখনো অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যানবাহনে উঠবেন না। রাতে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন। সম্ভব হলে যাতায়াতের লক্ষ্যে স্থানীয় কোনো চালকের সরণাপন্ন হতে পারেন। ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে মেনে চলুন।
রোগ প্রতিরোধে চাই সর্বোচ্চ সতর্কতা:
বনে, পাহাড়ে ভ্রমণের সময় পতঙ্গ বিশেষত মশার আক্রমণ থেকে রক্ষাকল্পে পাতলা ও লম্বা হাতাযুক্ত শার্ট ও ফুল পেন্ট, হাতমোজা, লম্বা পামোজা, মাথায় টুপি ব্যবহার করুন। এয়ার কন্ডিশন রুম না হলে বিশ্রামের সময় মশারি ব্যবহার করুন। এতে করে মশা বাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন- ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জাপানিজ এনকেফালাইটিস প্রভৃতি রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এড়িয়ে চলুন স্থানীয় যত বুনো কিংবা গৃহপালিত হিংস্র বিভিন্ন প্রাণী যেমন- কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল, বনকুকুর, বাগডাশ প্রভৃতি সংস্পর্শ থেকে। এতে করে এদের দ্বারা বাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন- প্লেগ, জলাতঙ্ক অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এড়িয়ে চলুন হাঁস-মুগরির খামার। সেই সাথে বিরত থাকুন বিভিন্ন বন্য পাখি ধরা থেকে। এতে করে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। অপরিষ্কার পুকুর বা হ্রদের পানিতে গোসল করবেন না। এতে বিভিন্ন কৃমির সংক্রমণ ও লেপ্টোস্পাইরোসিস নামক রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে ডাক্তার হতে পারে একজন উপযুক্ত পরামর্শক। তা কোনো পূর্ব পরিকল্পিত ভ্রমণের চার থেকে ছয় সপ্তাহ আগে হওয়াই সর্বোত্তম। কেননা, ভ্রমণের আগে বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধকল্পে টিকা ও অন্যান্য ওষুধের কার্যকারিত ওই সময়ের মধ্যেই প্রকাশ প্রায়। তবে ভ্রমণের আগে চার সপ্তাহের কম সময় অবশিষ্ট থাকলেও চিকিৎসকের সাথে ভ্রমণ বিষয়ক স্বাস্থ্য আলোচনায় লাভ বই ক্ষতি নেই। কেননা, এ ভ্রমণের মধ্যেই দেখা দিতে পারে ডায়রিয়া থেকে শুরু করে টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, জলাতঙ্ক, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, গোদরোগ, কালাজ্বর, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, লেপটোস্পাইরোসিস ও ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য মারাত্মক রোগ।
টিকা নিন ভালো থাকুন:
ভ্রমণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক শিশু, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষে সবাই টিকা না দেয়া থাকলে হেপাটাইসিস-এ, হেপাটাইটিস-বি, টাইফয়েড, সম্ভব হলে জাপানিজ এনকেফালাইটিস ও জলাতঙ্কের টিকা নিন। আর আগে কোনো রোগের টিকা দেয়া থাকলে প্রয়োজনবোধে টিকার কার্যকাল বৃদ্ধিকল্পে সংশিøষ্ট টিকার একটি অতিরিক্ত বুস্টার ডোজ নিয়ে নিন। সেই সাথে অবশ্যই বয়সভেদে শিশুদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অন্তর্গত ছয়টি মারাত্মক রোগ : যক্ষ্মা, ধনুষ্টঙ্কার, পোলিও, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, হাম ও বর্তমানে নতুন সংযোজিত হেপাটাইসিস-বি’র টিকা দেয়া নিশ্চিত করুন।
ম্যালেরিয়া থেকে সাবধান:
ম্যালেরিয়া প্লাজমোডিয়াম গনভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির পরজীবীরর মাধ্যমে মানবদেহে সংঘটিত এক প্রকার মারাত্মক জ্বর রোগ। সাধারণত কাপুনি দিয়ে নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া, মাথা ও সমস্ত শরীরে ব্যথা, বমি-বমি ভাব বা বমি হওয়া, রক্তস্বল্পতা, জন্ডিস ক্ষেত্র বিশেষে প্লাজমোজিয়াম ফেলসিপেরাম নামক পরজীবীঘটিত ম্যালেরিয়ায় তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এতে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, কিডনি ও ফুসফুসের কর্মক্ষমতা লুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
এতে দেহে দেখা দিতে পারে অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণ, দেখা দেয় খিঁচুনি রক্তের লোহিত কণিকাগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় ভাঙতে শুরু করে। রোগের চরম পর্যায়ে রোগী মারা যেতে পারে। এই রোগের সৃষ্টিকারী পরজীবী প্রধানত ওই পরজীবী সংক্রমিত স্ত্রী এনোফিলিস মশা কোনো মানুষকে কামড় দিলে তা মানব দেহে প্রবেশ করে এবং সাধারণত সাত থেকে ৯ দিন পর ম্যালেরিয়া জ্বরের উদ্রেক করে। কাজেই বাংলাদেশের কোনো জায়গায় বিশেষত দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব জেলাগুলোতে ভ্রমণের আগে রোগের মাত্রাভেদে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো এক সপ্তাহ আগে থেকে ভ্রমণ শেষের চার সপ্তাহ পর পর্যন্ত ডক্সিসাইক্লিন/মেফ্লোকুইনের ক্ষেত্রে কিংবা এটোভাকিউন/প্রোগুয়ানিল ওষুধের ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিরোধ কল্পে রোগবারক হিসেবে তা ব্যবহার করতে হবে। তবে ওই ওষুধ সেবনেই যে ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধ পুরোপুরি নিশ্চিত হবে তা নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওই ওষুধ সেবনের পরও ভ্রমণের সময় থেকে শুরু করে ভ্রমণের পরবর্তী এক বছরের মধ্যে যেকোনো সময় এই ম্যালেরিয়া জ্বর দেখা দিতে পারে। কাজেই ম্যালেরিয়া-প্রবণ এলাকা বিশেষত বাংলাদেশের দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে কেউ ভ্রমণের সময় বা ভ্রমণ পরবর্তী এক বছরের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত হলে তার যথাযথ কারণ নির্ণয়পূর্বক রোগী ম্যালেরিয়ার আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
বিরত থাকুন অনিরাপদ যৌনাচার থেকে। কিংবা যৌনাচারের সময় কনডম ব্যবহার করুন। এতে করে এইডস, হেপাটাইটিস-বি, গণোরিয়া, সিফিলিসসহ আরো অনেক যৌন রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। একই নিডল দিয়ে অনেকে একসাথে গায়ে উল্কি আঁকা থেকে বিরত থাকুন। একই সুই ও সিরিঞ্জ দিয়ে একসাথে অনেকে কোনো ওষুধ নেবেন না। এতে করে এইডস, হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-বি প্রভৃতি রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। খালি পায়ে কখনো বাইরে হাঁটবেন না। পা নিয়মিত পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখুন। এতে করে বিভিন্ন ছত্রাক ও কৃমি জাতীয় পরজীবীর সংক্রমণ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।