নিজস্ব প্রতিবেদক:
এবার বাজেট হবে ‘চাপাচাপির’ বাজেট ও সে কারণে কর বাড়বে—এমন ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সে অনুপাতে ভ্যাটসহ নানাভাবে করের বোঝা চেপেছে মানুষের ওপর। কিন্তু সে চাপ যে এতোটা প্রকট হবে, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। নানামুখী চাপে থাকা এসব মানুষের শেষ ভরসা ব্যাংকে রাখা কষ্টার্জিত আয়ের কিছু সঞ্চয়। এবার বাজেটে সেই সঞ্চয়ের ওপর নতুন করে আরেক দফা আবগারি শুল্ক বসিয়েছে সরকার। আর সেটি এমনভাবে বসিয়েছে যে, বছর শেষে ব্যাংক যে লাভ দেয়, সেটি তো পাবেনই না, এমনকি শুল্ক ও আয়করসহ ব্যাংকের নানা খরচাপাতির পর কাটা যেতে পারে মূল আমানতের কিছু অংশও।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকে এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) যদি ৮০০ টাকা কেটে রাখা হয়, তাহলে আমানতকারী কোনো লাভই পাবেন না। আর সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে এফডিআর করলে, মেয়াদ শেষে লাভের বদলে নিজের আসল টাকা থেকেই কম পাবেন গ্রাহক।
এমনিতেই ব্যাংক আমানতের সুদ কমে গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো গড় সুদ হার ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। সামান্য এই সুদের ওপর কর নিচ্ছে সরকার, রয়েছে ব্যাংকের নানা চার্জ। আগামীতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এসব নিয়ে নানা সমালোচনা ও উদ্বেগের মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার বাজেটে ব্যাংকে জমা রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক ৬০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন অর্থমন্ত্রী। এমন খবরে আগে থেকেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন আমানতকারীরা। এখন আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবের পর মাথায় হাত পড়েছে তাদের। বেশি উদ্বেগে পড়েছেন দেশের এক কোটি আমানতকারী।
বাজেট ঘোষণার আগে থেকেই আবগারি শুল্ক নিয়ে আলোচনা ছিল। বাজেটে প্রস্তাব করার পর সবকিছু ছাপিয়ে দেশে এখন প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি। সবকিছু বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষ এখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন ও কথা বলছেন। এসব মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেদের কাছে বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থায় টাকা রাখার কথা চিন্তা করছেন। বিশেষ করে নারীরা কষ্ট করে ব্যাংকে টাকা জমান পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য। সে টাকা তারা নেন স্বামী, মা, বাবা, ভাই- বোনদের কাছে থেকে। পরিবারের বিপদে, সন্তানের লেখাপড়া, চিকিৎসা বা আকস্মিক কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পেতে। সেই টাকার ওপর যদি সরকার শুল্ক বসায়, তা হলে তাদের বিপদের আর শেষ থাকবে না।
এমন সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে সরকার। সরব ব্যবসায়ীদের সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভোক্তা সংগঠনগুলো। অর্থনীতিবিদরা এই বিষয়কে ‘অযৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তারা সরকারের কাছে এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, আমানতকারীরা এতো ঠকতে থাকলে সঞ্চয় অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে চলে যাবে। ফলে এ নিয়ে সরকারকে আরো ভাবতে হবে।
অবশ্য সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়াম লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করে ব্যাংকে আমানতের ওপর আবগারি শুল্কের বিষয়টি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন। গতকাল সিরাজগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাবটি কেবল অসমর্থনযোগ্যই নয়, অন্যায়ও। অন্যান্য রাষ্ট্রে এই শুল্ক আরোপ করা হয় মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ীদের ব্যাংক আমানতে। সরকারের কাজ হচ্ছে, মানুষকে ব্যাংকমুখী করা। কিন্তু এই শুল্ক আরোপের ফলে সাধারণ মানুষ এখন ব্যাংকবিমুখ হতে বাধ্য হবেন। মানুষকে ব্যাংকে লেনদেনে নিরুৎসাহিত করার মতো উদ্যোগ সরকার নিতে পারে না।
এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, রাজস্ব বাড়তে পারে, এই চিন্তা থেকে হয়তো সরকার আবগারি শুল্ক আরোপের চিন্তা-ভাবনা করছে। এতে হিতে বিপরীত হবে। কারণ, টাকা রেখে যদি লাভই না পায়, তা হলে মানুষ ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখবেন। ফলে এই টাকার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারের কাছে কোনো তথ্য থাকবে না। সরকার সেসব টাকার কোনো করও পাবে না। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখলেই সরকার ট্যাক্স পায়। ফলে অবশ্যই সরকারের আবগারি শুল্কের প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা উচিত। এ বিষয়ে পাশের দেশ ভারতের একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ আছে। দেশটিতে এক হাজার টাকার নোট বাতিলের পর দেখা গেল, গ্রোথ লেভেল কমে গেছে। আবগারি শুল্কের ফলে ট্যাক্সও কমবে। মানুষ ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারাবে- বলেও মত দেন অধ্যাপক আবু আহমেদ।
ব্যাংক লেনদেনে আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় অর্থ ‘পাচার’ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ব্যাংক খাত থেকে আবগারি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, মূলধন গঠন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তথা সামগ্রিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য গ্রাহকরা ব্যাংক লেনদেন করে থাকেন। বাজেটে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক বিভিন্ন হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে আমানতকারী আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হবে। এ ছাড়া অর্থ ব্যাংক চ্যানেলে না গিয়ে ইনফরমাল চ্যানেলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি স্বাস্থ্য হানিকর পণ্য ছাড়া অন্য কোনো খাতে আবগারি শুল্ক আরোপ করা সমীচীন নয় বলেও মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
গত বৃহস্পতিবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকার বেশি লেনদেনে আবগারি শুল্ক বিদ্যমান ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। তবে শুল্কমুক্তসীমা ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে বছরের যেকোনো সময় ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেনে শুল্ক দিতে হতো না, এখন এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হবে না। বাজেটের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, আমানত ও ঋণ উভয় হিসাব থেকে বছরে একবার আবগারি শুল্ক বা এক্সাইজ ডিউটি কাটা হয়। বর্তমানে বছরের যেকোনো সময় অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডেবিট বা ক্রেডিট হলে সেক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক কাটা হয় না। আগামী অর্থবছর থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত শুল্ক কাটা হবে না। তবে এক লাখ টাকার বেশি থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ টাকার বেশি থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে দুই হাজার ৫০০ টাকা, এক কোটি টাকার ওপর থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত সাত হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং পাঁচ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে বিদ্যমান ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অবশ্য আবগারি শুল্ক আরোপের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, বর্তমান সরকারের সব পর্যায়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নীতি ও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির ফলে ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের আকার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এ বিবেচনায় এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
কিন্তু অর্থমন্ত্রীর এমন যুক্তি সঠিক নয় বলে মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের। তারা জানান, আবগারি শুল্কের বাইরে বর্তমানে ব্যাংকে আমানত রেখে গ্রাহকরা যে সুদ পান, তার ওপর ১০ শতাংশ কর কাটা হয়। আর ট্যাক্সপেয়ারস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে দিতে হয় ১৫ শতাংশ। এর পাশাপাশি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন নামে চার্জ কাটে। সেই সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো আবগারি শুল্ক। ফলে আমানতকারী বছর শেষে তার আমানত থেকে কোনো লাভ নাও পেতে পারেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আশানুরূপ বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় এমনিতেই ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ হার অনেক কমিয়ে এনেছে। এখন আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলে আমানতকারীরা মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়বেন। আতঙ্ক থেকে ব্যাংক-বিমুখ হবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত হিসাব রয়েছে আট কোটির মতো। এসব হিসাবে মোট জমা আছে নয় লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি মেয়াদি আমানত। সঞ্চয়ী আমানত রয়েছে ২০ শতাংশের মতো। আমানতের সুদ হারের নিম্নমুখী প্রবণতা রোধ করার পরামর্শ দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে একটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই পরামর্শ কোনো কাজে আসেনি। আমানতের সুদ হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। সরকারি ব্যাংকগুলো এখন মেয়াদি আমানতে সুদ দিচ্ছে সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ সঞ্চয় স্কিমেও সুদ হার এ রকম পর্যায়ে নেমেছে। ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা রাখলে এখন নামমাত্র সুদ পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে গত এপ্রিলে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ হার প্রথমবারের মতো ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশে নেমেছে। অথচ বর্তমানে গড় মূল্যস্ফীতি রয়েছে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ এখন ব্যাংকে টাকা রেখে প্রকৃতপক্ষে কোনো মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এমনিতেই আমানতকারীরা সুদের হার কম পাচ্ছেন। এর সঙ্গে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখাও হচ্ছে। তার ওপর আবার শুল্ক আরোপ করা হলে আমানতকারীরা শঙ্কায় থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। শুধু ব্যাংকে টাকা রাখবে—কেবল সেই কারণেই সরকার টাকা কেটে নেবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। এর ফলে এখন মানুষ ব্যাংক বিমুখ হবে। ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে টাকা রাখা শুরু করবে। অস্বচ্ছ খাতে টাকা রাখবে। অনেকে টাকা দেশের বাইরেও নিয়ে যাবে।
এই করারোপকে খারাপ ট্যাক্স উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এভাবে করারোপ করা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। টাকা দরকার, কিন্তু যে কোনোভাবে নয়। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব কার্যকর হলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবেন।
দৈনিক দেশজনতা/ এমএইচ