আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দিনে ক্রিকেট খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, আর রাতে হানা দিচ্ছেন নাইটক্লাবে। এক সময় ইমরান খানের নাম বললে এমনই এক সুদর্শন যুবকের চেহারা চোখে ভেসে উঠত। তবে এখন সেই ইমেজ অতীত হয়েছে; নিজেকে ধার্মিক ও নীতিবান হিসেবে হাজির করতে সচেষ্ট তিনি। পাকিস্তানকে বদলে দেওয়ার কথা বলে রাজনীতিতে নামা ৬৫ বছর বয়সী ইমরান খান এভাবেই বদলে নিয়েছেন নিজেকে। ব্যক্তিগত জীবনের মতো তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও বর্ণাঢ্য।
পাকিস্তানকে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ এনে দিয়ে লিজেন্ডে পরিণত হয়েছেন। পরে নেমেছেন রাজনীতিতে। আর এখন বসতে চলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে। গত বুধবার দেশটিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইমরানের রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর চেয়ে বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তিনিই যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, তা প্রায় নিশ্চিত। ‘নতুন পাকিস্তান’ স্লোগান নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তরুণদের মন জয় করে নেন ইমরান খান। এককালের প্লেবয় ইমেজ ও তিন তিনটি বিয়ে তার সাম্প্রতিক উত্থানে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।
১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর লাহোরে জন্ম ইমরান খানের। তার বাবা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজী ছিলেন প্রকৌশলী। ধনাঢ্য বাবার সূত্রে ইমরান লেখাপড়া করেছেন লাহোর ও যুক্তরাজ্যে। লাহোরে পড়ালেখা শেষে যুক্তরাজ্যে গিয়ে ওরসেস্টারের রয়্যাল গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন ইমরান। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবলে কলেজ থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিল তার অদম্য আকর্ষণ।
১৯৭২ সালে টেস্ট ক্রিকেটে এবং ১৯৭৪ সালে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় ইমরানের। অভিষেকের পর ১৯৮২-১৯৯২ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তানি ক্রিকেটের। হয়েছেন দেশটির সফলতম অধিনায়ক। ১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বেই পাকিস্তান তাদের ইতিহাসের একমাত্র বিশ্বকাপটি ঘরে তোলে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট অলরাউন্ডারদের তালিকাতেও তার স্থান ওপরের সারিতে। ১৯৯৩ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ইমরান খান।
১৯৯৫ সালে ৪৩ বছর বয়সে ইমরান খান বিয়ে করেন ব্রিটিশ নাগরিক জেমিমা গোল্ডস্মিথকে। ২০০৪ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। এর পর ২০১৫ সালে বিয়ে করেন রেহাম খানকে। এক বছরের মধ্যে এ সম্পর্ক ভেঙে গেলে চলতি বছরই ফের বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ইমরান।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। তবে খেলার মাঠ থেকে উঠে আসা ইমরানের রাজনীতির ময়দানে ডানা মেলে ওড়া ততটা সহজ ছিল না। ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয় পেতে ব্যর্থ হন তিনি। ২০০২ সালের নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই জয়ের দেখা পান। ২০০৮ সালের নির্বাচন বয়কট করে দলটি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতির অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা দেন। ৩৫টি আসন নিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয় পিটিআই। দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এবং পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপ্রীতির কট্টর সমালোচনার কারণে দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ইমরানের। পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন বড় নেতা যোগ দিলে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তার দল।
তবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ইমরান খানের। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে অধিকাংশ সময়ই দেশটির শাসনক্ষমতায় থাকা সেনাবাহিনী এবারও নির্বাচনে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে এবং তাতে ইমরান খানই সুবিধা পাবেন বলে জোর গুঞ্জন ছিল। ইমরানকে সুবিধা দিতে সেনা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তার বিরোধীদের নানা কৌশলে দুর্বল করে দিচ্ছে বলেও ধারণা করা হচ্ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতির সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বিশ্লেষকদের এ ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ইমরানের বিরুদ্ধে আরেক অভিযোগ, তার সঙ্গে দেশটির জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর তৎপরতাকে তিনি ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবিরোধী অভিযানেরও কট্টর বিরোধী তিনি। ধর্মপ্রাণ মানুষের মন জয় করতে তিনি ধর্মকে সামনে নিয়ে এসেছেন বলেও মনে করা হয়।
২০১৩ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়া পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত পাঁচ বছর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন ইমরান। এর মধ্যেই বহুল আলোচিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম ওঠে নওয়াজ ও তার পরিবারের সদস্যদের। আদালতের রায়ে ক্ষমতাচ্যুত ও দলের প্রধানের পদ হারান নওয়াজ। এখন তিনি মেয়ে মরিয়মসহ কারাগারে রয়েছেন। নওয়াজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ জয় ইমরানের আত্মবিশ্বাস ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে নিয়ে যায়। যার ফল দেখা যাচ্ছে এ নির্বাচনে।