২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১০:২৬
অলিভিয়ের জিরুর হাতে সোনালি ট্রফি। কনফেত্তিও উড়ছে সোনালি রঙের। ফরাসি সুরভি ছড়িয়ে নীল উচ্ছ্বাসে ভাসল ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স-এএফপি

ফ্রান্সের দুনিয়া কাঁপানো জয়

ক্রীড়া প্রতিবেদক:
রাশিয়া বিশ্বকাপে সবচেয়ে সুন্দর গল্পটি ছিল মাত্র ৪১ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে উঠে আসা। কিন্তু সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখা মুছে দেয়া ক্রোট রূপকথার শেষটা হল বড় বিয়োগান্তক। দৃষ্টিসীমায় এসেও দূরদিগন্তে হারিয়ে গেল পরম আরাধ্য সোনার ট্রফিটা।

ফরাসি বিপ্লবের সর্বগ্রাসী ঢেউ ক্রোটদের হৃদয় ভেঙে আগামী চার বছরের জন্য ফুটবলের ক্যানভাসটা করে দিল নীল। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে রবিবাসরীয় রাতে দুনিয়া কাঁপানো জয়ে ২০ বছর পর আবার বিশ্বকাপটা নিজেদের করে নিল ফ্রান্স।

ছয় গোলের রোমাঞ্চকর ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ভরা লুঝনিকিতে নীল পদ্ম ফোটালেন গ্রিজমান, এমবাপ্পে, পগবারা। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল দিদিয়ের দেশমের নেতৃত্বে। এবার কোচ হিসেবে দেশকে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দিয়ে মারিও জাগালো ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পাশে বসে গেলেন দেশম। শেষ বাঁশি বাজতেই দেশমকে মাথায় তুলে কয়েকবার শূন্যে ছুড়লেন গ্রিজমান, পগবারা।

গ্যালারির লাল-সাদা অংশে তখন হতাশা আর কষ্টের মাখামাখি। মাঠে গ্রিজমানদের চোখে আনন্দ অশ্রু। আর সুবাসিচদের চোখ বেয়ে ঝরছিল হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা। মডরিচদের সেই কষ্টের ভাগিদার হয়ে কাঁদল মস্কোর আকাশও।

বৃষ্টির মধ্যেই বিশ্বসেরার মুকুট ফ্রান্স অধিনায়ক হুগো লরিসের হাতে তুলে দিলেন জার্মান কিংবদন্তি ফিলিপ লাম। বিশ্বসেরার ব্যাটন হস্তান্তর হতেই উড়ল সোনালি কনফেত্তি। তা সবুজ মাঠের একাংশ ঢেকে দিলেও নীলের উজ্জ্বলতা এক বিন্দুও ম্লান করতে পারেনি। ভেজা মাঠেই বুনো উল্লাসে মাতলেন ফ্রান্সের বিশ্বজয়ী দামাল তরুণরা।

১৯৯৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জিদানের ফ্রান্সের কাছে হেরে থেমেছিল সুকেরের ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রা। দুই দশক পর আরও বড় মঞ্চে সেই ফ্রান্সের হাতেই খুন হল প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা মডরিচের ক্রোয়েশিয়ার শিরোপা-স্বপ্ন। ফ্রান্সের তরুণ ব্রিগেডের গতির ঝড় স্তব্ধ করে দিল ক্রোয়েশিয়ার সোনালি প্রজন্মকে।

গোলপ্রসবা ফাইনালে মানজুকিচের আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর একে একে ক্রোয়েশিয়ার বুকে ছুরি চালান ফ্রান্সের তিন স্বপ্নসারথি- আঁতোয়া গ্রিজমান, পল পগবা ও কিলিয়ান এমবাপ্পে। ইভান পেরিসিচ ও মানজুকিচ দুটি গোল ফিরিয়ে দিলেও শেষরক্ষা হয়নি ক্রোয়েশিয়ার। তবে শেষটা বিয়োগান্তক হলেও মডরিচদের চোয়ালবদ্ধ লড়াই ক্রোয়েশিয়ার নতুন প্রজন্মের চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বীজ ঠিকই বুনে দেবে।

শিরোপা-যুদ্ধে দু’দলই নেমেছিল অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে। ফাইনালের আগে নকআউট পর্বে ক্রোয়েশিয়ার তিনটি ম্যাচই গড়িয়েছিল অতিরিক্ত সময়ে। কিন্তু কাল শুরুতে ক্রোটদের খেলায় ক্লান্তির কোনো ছাপ দেখা যায়নি। শুরু থেকে বল দখলে রেখে আক্রমণে এগিয়ে ছিল ক্রোয়েশিয়া। তবে ভালো কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি।

খেলার ধারার বিপরীতে ফ্রান্স এগিয়ে যায় মারিও মানজুকিচের আত্মঘাতী গোলে। ১৮ মিনিটে ডি-বক্সের অনেক বাইরে থেকে আঁতোয়া গ্রিজমানের ফ্রিকিক হেডে বিপদমুক্ত করতে চেয়েছিলেন সেমিফাইনালের জয়সূচক গোলদাতা। কিন্তু বল তার মাথা ছুঁয়ে কিছুটা দিক পাল্টে জালে জড়িয়ে যায়। কিছুই করার ছিল না গোলকিপার দানিয়েল সুবাসিচের।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে এটাই প্রথম আত্মঘাতী গোল। আগের তিন ম্যাচেই শুরুতে গোল খেয়ে ম্যাচে ফিরেছিল ক্রোয়াটরা। এবারও ফিরতে বেশি সময় লাগেনি। ২৮ মিনিটে দোমাগয় ভিদার পাস থেকে দুর্দান্ত শটে সমতাসূচক গোলটি করেন ইভান পেরিসিচ।

ফ্রিকিক থেকে ডি-বক্সে আসা বল জটলা থেকে ভিদা কাটব্যাক করেছিলেন। ডান পা দিয়ে বল আয়ত্তে নিয়ে বাঁ পায়ের জোরালো শটে গোলকিপার হুগো লরিসকে ফাঁকি দেন সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও সমতা ফেরানো পেরিসিচ। টুর্নামেন্টে এটি তার তৃতীয় গোল। তবে সমতা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি ক্রোটরা। ১০ মিনিট পর আবার এগিয়ে যায় ফ্রান্স। কর্নার থেকে ডি-বক্সে আসা বলে লেগেছিল পেরিসিচের হাতের ছোঁয়া।

রেফারি মাঠের বাইরে গিয়ে ভিডিও রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত দেন পেনাল্টির। স্পটকিক থেকে ঠাণ্ডা মাথায় টুর্নামেন্টে নিজের চতুর্থ গোলটি করেন গ্রিজমান। এরপর আক্রমণের ঝড় তুললেও ২-১ গোলে পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় ক্রোয়েশিয়া।

১৯৭৪ আসরের পর এই প্রথম প্রথমার্ধে তিন গোল দেখল কোনো বিশ্বকাপ ফাইনাল। ম্যাচে এগিয়ে থাকলেও প্রথমার্ধে ফ্রান্স ঠিক ফেভারিটের মতো খেলতে পারেনি। ভাগ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় পাওয়া তাদের দুটি গোলের উৎস ছিল সেটপিস। ওপেন প্লেতে ক্রোয়েশিয়াই বরং ভালো খেলেছে। ৬৬ শতাংশ সময় বল ছিল তাদের দখলে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ম্যাচে সমতা ফিরতে পারত। ইভান রাকিতিচের বাড়ানো বল ধরে আন্তে রেবিচের শট দুর্দান্তভাবে ঠেকান ফরাসি গোলকিপার লরিস।

৫২ মিনিটে ম্যাচে প্রথমবারের মতো জ্বলে উঠেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। পল পগবার বাড়ানো বল ধরে দুর্দান্ত গতিতে ভিদাকে পেছনে ফেলে ডি-বক্সে ঢুকে শট নিয়েছিলেন ফরাসি তরুণ তুর্কি। পা দিয়ে এ যাত্রায় ঠেকিয়ে দেন সুবাসিচ। এরপর আরেক নাটক। মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন এক বেয়াড়া দর্শক। নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে সরিয়ে আনার পর শুরু হয় গোল-উৎসব। ১০ মিনিটের ব্যবধানে তিন গোল।

৫৯ মিনিটে অনেকটা খেলার ধারার বিপরীতেই গোল পেয়ে যায় ফরাসিরা। বাঁ দিক থেকে দুই ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে ডি-বক্সে এমবাপ্পের ক্রস ধরে গ্রিজমান বল পাঠান পেছনে থাকা পল পগবাকে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই মিডফিল্ডারের ডান পায়ের প্রথম শট প্রতিহত হয় রক্ষণ দেয়ালে। তবে ফিরতি বলে বাঁ পায়ের শটে এবারের আসরে নিজের প্রথম গোলটি তুলে নেন পগবা। ৬৫ মিনিটে লুকাস হার্নান্দেজের পাস থেকে দুর্দান্ত এক গোলে ম্যাচ কার্যত শেষ করে দেন এমবাপ্পে। এবারের বিশ্বকাপে এটি তার চতুর্থ গোল। পেলের পর প্রথম টিনএজার হিসেবে ফাইনালে গোল পেলেন ১৯ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। এরপরই গোলকিপার লরিসের মারাত্মক ভুল।

ব্যাকপাসে বল পেয়ে অযথা এগিয়ে আসা মানজুকিচকে কাটাতে চেয়েছিলেন। পারেননি, মানজুকিচের বুটের আলতো টোকায় বল চলে যায় জালে। আশা জাগে ক্রোট শিবিরে। তবে শেষ পর্যন্ত ক্রোয়েশিয়া আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি।

গত ১৪ জুন মস্কোর লুঝনিকিতে বিশ্বকাপের বোধনের দিনে ৩২ দলের ৭৩৬ ফুটবলারের সবার চোখেই ছিল শিরোপা-স্বপ্ন। একে একে সেই স্বপ্নের মশালবাহকের সংখ্যাটা কমেছে। তবে অঘটনপ্রসবা এই বিশ্বকাপ সবার স্মৃতিতেই অমলিন থাকবে। এই আসরটা মনে রাখার মতো উপলক্ষের অভাব নেই। গায়ে ফেভারিটের তকমা লাগানো বড় দলগুলোর অকাল বিদায়, মহাতারকাদের ঝরে পড়া, ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রা, ভূরি ভূরি রেকর্ড, আত্মঘাতী গোলের হিড়িক, ভিএআর প্রযুক্তি- ইতিহাসের ফ্রেমে ঠাঁই পাওয়ার মতো ঘটনার কোনো কমতি ছিল না।

এর বাইরে ৬৪ ম্যাচের প্রায় প্রতিটিই অনেক হিরণ্ময় মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে। সাক্ষী হয়েছে অনেক বিতর্কেরও। হট ফেভারিট ব্রাজিলের হেক্সা অভিযান শেষ আটে থেমে গেলেও মাঠে দলটির প্রাণভোমরা নেইমারের নাটুকেপনা বিতর্কের পাশাপাশি বিনোদনের এক নতুন অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

ফ্রান্সের তরুণ তুর্কি কিলিয়ান এমবাপ্পের গতির ঝড় যেমন শিহরণ জাগিয়েছে, ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড জেনারেল লুকা মডরিচ তেমনি বুড়ো হাড়ের ভেলকিতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। গতবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির গ্রুপপর্ব থেকে ছিটকে যাওয়ার ব্যাপারটি একপাশে সরিয়ে রাখলে এবারের আসরে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে লাতিন দলগুলো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রুপপর্ব পেরনো আর্জেন্টিনা কাটা পড়ে দ্বিতীয় রাউন্ডেই।

কলম্বিয়াও পেরোতে পারেনি শেষ ষোলোর সীমানা। ব্রাজিল ও উরুগুয়ের বিদায়ঘণ্টা বাজে শেষ আটে। ফলে সেমির আগেই বিশ্বকাপ থেকে লাতিন নিশানা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দুটি অল-ইউরোপিয়ান সেমিফাইনালে বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের স্বপ্নযাত্রা থামিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে উঠে আসে ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়া। শেষ অঙ্কে ছয় গোলের অবিস্মরণীয় শিরোপা-যুদ্ধে ক্রোট রূপকথা থামিয়ে বিশ্বকাপের মসনদ আগামী চার বছরের জন্য নিজেদের করে নিল ফ্রান্স।

প্রকাশ :জুলাই ১৬, ২০১৮ ১০:০৪ পূর্বাহ্ণ