নিজস্ব প্রতিবেদক:
মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া গ্রাম। গ্রামটিতে প্রায় ৩শ’ পরিবারের বসবাস। বাইরের যে কেউ এ গ্রামে ঢুকলে অবাকই হবেন। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে লেবু গাছ। কারণ বাড়ির উঠান, আঙিনা যেখানেই ফাঁকা জায়গা, সেখানেই লেবু গাছ লাগানো হয়েছে। আছে দেড় শতাধিক ছোট-বড় লেবুর বাগান। লেবুচাষের বিস্তৃতি আর সাফল্যে ‘বালিয়াখোড়া’ এখন পরিচিত লেবুর গ্রাম নামে। এ গ্রামের বাতাসে ভেসে বেড়ায় লেবুর ঘ্রাণ। যেন এটি কোনো গ্রাম নয় বরং বিস্তীর্ণ এক লেবু বাগান।
বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের বালিয়াখোড়া গ্রামের তিন শতাধিক এবং পার্শ্ববর্তী সোদঘাটা গ্রামের প্রায় দুই শ’ পরিবারের প্রধান আয় এই লেবু চাষ। এলাচি, কাগজি ও কলম্বো জাতের লেবু চাষ হয় এখানে। সুগন্ধি, সুস্বাদু ও প্রচুর রসযুক্ত হওয়ায় এই গ্রামের লেবুর কদর সবচাইতে বেশি। এখানকার উৎপাদিত লেবু বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার ও গাজীপুরের টঙ্গী বাজারে। এলাকার অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক লেবু চাষের আয় দিয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। বালিয়াখোড়ার চাষীদের উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের লেবু ঢাকার পাইকারদের মাধ্যমে দেশ ছাড়িয়ে স্থান করে নিয়েছে বিশ্ববাজারে। চলতি মৌসুমে সৌদি আরব, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৫ টন লেবু রফতানি করা হয়েছে।
বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল খান বলেন, বালিয়াখোড়া গ্রামে ৩শ’ পরিবার বাস করে। এই গ্রামে ছোট-বড় মিলে কমপক্ষে ১৫০টি লেবুর বাগান আছে। তবে সব বাড়িতেই লেবু গাছ আছে। এই গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ লেবু চাষের আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সারাবছরই তারা বাগানে মাটি তোলা, চারা তৈরি, সার দেয়াসহ লেবু তুলে বাজারে বিক্রি করাসহ বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকেন।
তিনি বলেন, লেবু চাষে ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ সার, ভিটামিন এবং কীটনাশক লাগে। কৃষি বিভাগ থেকে লেবু চাষিদের কোনো সহায়তা দেয়া হয় না। কৃষি বিভাগ একটু নজর দিলে লেবুচাষিরা আরো ভালো করবে।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র বলেন, তার বাবা রুহিণীকান্ত হোড় পার্শ্ববর্তী গ্রামের আলী হোসেন ঘড়ি মিয়ার নিকট থেকে ১০টি লেবু গাছের চারা নিয়ে এই গ্রামে প্রথম লেবু চাষ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর থেকে তিনি এই লেবু বাগানের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে তার ৪টি লেবুর বাগান আছে। ১৫০ শতাংশ জমির এই বাগানগুলোতে তিনি এলাচি, কাগজি ও কলম্বো-এই তিন জাতের লেবুর চাষ করেছেন। এর মধ্যে ১০০ শতাংশ জমিতে কলম্বো, ৪০ শতাংশ জমিতে এলাচি ও ১০ শতাংশ জমিতে কাগজি লেবুর চাষ করেন। তিনি বলেন, অনেক সময় গাছে পোকা লাগে, গাছ মরে যায়। কিন্তু কৃষি বিভাগের কেউ তাদের খোঁজ নেন না। তাদের দিকে সরকারের কোনো নজর নেই।
লেবু চাষী বিলু মিয়া জানান, ১শ’ লেবু ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি বস্তা লেবু বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮শ’ টাকা থেকে ৪ হাজার ২শ’ টাকা পর্যন্ত। প্রতিটি বস্তায় ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ লেবু থাকে। আর লেবুর ধরন অনুযায়ী প্রতিটি লেবু ৫ টাকা থেকে সাড়ে ৮ টাকা হারে বিক্রি হচ্ছে।
এলাকার মফিজুল ইসলাম দীপন বলেন, তার বাবা মরহুম মাসুদুল হক ৩৫ বছর আগে লেবুর বাগান করেন। বাবার মৃত্যুর পর তার ভাইরা মিলে এই লেবুর চাষ করছেন। বর্তমানে ২৪০ শতাংশ জমিতে লেবুর চাষ হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তারা তাদের কোনো খোঁজ নেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা দিলে তারা লেবু চাষে আরও সফল হতে পারবেন বলেও জানান।
বিদেশে বিভিন্ন সবজীজাত পণ্য রফতানিকারক ঢাকার ব্যবসায়ী মো: ফারুক খান বলেন, চৌধুরী চলতি মৌসুমে সৌদি আরব, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৫ টন লেবু রফতানি করা হয়েছে। বেশিরভাগ লেবুই তিনি সংগ্রহ করেন মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে। ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আশরাফ উজ্জামান খান বলেন, ঘিওরের বালিয়াখোড়া ও সোদঘাটা গ্রামের চাষীরা লেবু চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন। এ অঞ্চলের লেবুর কদর রয়েছে সারা দেশে। এখন বিদেশীদেরও খাবার তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে ঘিওরের লেবু।
তিনি আরো বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আছেন। তারাই মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের সমস্যার সমাধার দেয়ার কথা। যদি কোনো গাফিলতি করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কৃষি বিভাগ থেকে ওই এলাকার লেবুচাষিদের সবধরনের সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।