২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:০৯

মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তা: ক্ষতি এড়ানোর উদ্যোগ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক:

মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ঠিক রাখতে বহুতল ভবনের ছাদে টাওয়ার বসিয়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করলেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এসব টাওয়ারের বিকিরণ থেকে মানব শরীরে এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা গবেষণায় উঠে এলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনের ওপর টাওয়ার বসানোয় বিস্মিত প্রাণিবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা।
তারা বলছেন, যে ছাদের ওপর টাওয়ার বসানো হয়েছে, সেই ভবনের বাসিন্দারা সবসময় মাইক্রোওয়েভের মধ্যে থাকছেন। এর ফলে তারা দিনে দিনে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হওয়ার পথে এগুচ্ছেন।
যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাসহ শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ভীষণ রকম ক্ষতির কারণ। সরেজমিনে দেখা যায়, কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্তমানে ষোলটি মোবাইল টাওয়ার রয়েছে। একাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টাওয়ার লাগানোর সময় অপারেটরগুলো কর্তৃপক্ষকে ল্যাব বানিয়ে দেওয়া, কম্পিউটার ল্যাব তৈরি করে দেওয়াসহ নানা প্রস্তাব দিয়ে রাজি করিয়ে থাকে।
অথচ ভয়ঙ্কর বিকিরণ শরীরে ঢুকলে কী কী ক্ষতি হতে পারে সেটি নিয়ে কেউ কোনও কথা বলছেন না বলে উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. গোলাম মোহাম্মদ ভুঞা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন বহিস্থ তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণে অবস্থান করলে এই বিকিরণক্ষেত্র আন্তঃকোষীয় যোগাযোগকে বিকৃত করে। ফলে ভুল ও বিকৃত সংকেতের কারণে কোষপর্দা শক্ত হয়ে যায় এবং বিষাক্তদ্রব্য বের হতে পারে না। এতে কোষটি বিষাক্ত হয়ে গেলে জেনেটিক পরিবর্তন থেকে শুরু করে স্মরণশক্তি লোপ, লিউকেমিয়া ও ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেয়।’
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কাছে মোবাইল ফোন ও টাওয়ারের বিকিরণ পরিমাপের কোনও যন্ত্র নেই। ফলে বিটিআরসি বিকিরণ পরিমাপের কাজটিও করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিটিআরসির ২০৪তম কমিশন সভায় বিকিরণ পরিমাপের জন্য দুটি যন্ত্র কেনার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য বরাদ্দও চাওয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে কমিশন যন্ত্র দুটি কেনার উদ্যোগ নেবে বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের পর্যবেক্ষণ বলছে, গত কয়েক বছরে বাংলা একাডেমি, উদয়ন স্কুল, অমর একুশে হলের পেছনে, জগন্নাথ হলের পাশে পাখি বসছে আগের তুলনায় কম। এক দুইটা পাখির বাসা কখনও দেখা গেলেও সেখানে ডিম ফোটাতে দেখা যায় না।
প্রাণীবিজ্ঞানীরা বলছেন, মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণের কারণে গত দশবছরে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলার গাছ ও পাখি। আর মানবশরীরে যে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তা অকল্পনীয়। সহজে দৃশ্যমান না হলেও মোবাইল ফোন ও মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তার মধ্যেই বাসকরতে গিয়ে অটিজমের শিকার হচ্ছে শিশুরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক নূরজাহান সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ইলেক্ট্রো ম্যাগনেট রেডিয়েশনে পাখি কমফোর্ট বোধ করে না ফলে তারা মোবাইল টাওয়ার আছে তার আশেপাশের গাছে বসে না, বাসা বাধে না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাংলা একাডেমি বা উদয়ন স্কুলের সামনে আগে পাখি যতটা থাকতো এখন থাকে না। তিনি বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করে পর্যবেক্ষণে দেখেছি এখানে যে তেঁতুল গাছটি ছিল সেখানে আগে অনেক তেঁতুল হতো, এখন হয় না। পাখি ও গাছের যখন এই অবস্থা তখন মানুষের কী হতে পারে প্রশ্ন করে তিনি আরও বলেন, বডিসেলগুলো ঠিকমতো কাজ করে না, সেখান থেকে ছোট ছোট টিউমার হয় পরে সেটি ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
যদিও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের সাবেক প্রধান গোলাম ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দীর্ঘদিন এধরনের বিকিরণে শারীরিক নানা ক্ষতি হবে এটা স্বাভাবিক। যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের আরও আগে ক্ষতি হবে। তবে সরাসরি ক্যান্সার হবে এধরনের শঙ্কা আমি করছি না কারণে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনও আমার জানা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী লুৎফর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিভিন্ন ছাত্রাবাসসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মোট ১৬টি টাওয়ার রয়েছে। উদয়ন স্কুলের ওপরে যে টাওয়ার ছিল সেটি সম্প্রতি ভবনের ফ্লোর বাড়ানোর সময় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেটি ক্ষতিকর বা নিষেধাজ্ঞা জাতীয় কোন কারণে নয়।
এসব টাওয়ার সরিয়ে ফেলা হবে বলে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ইতোপূর্বে জানিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা তা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এধরনের কোনও সিদ্ধান্ত কখনও নেওয়া হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। আপনার কাছেই শুনলাম, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে তবেই বলা সম্ভব।’
এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তা মাইক্রোওভেনের বিকিরণের মতোই। সংস্থাটির গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, বিকিরণের একেবারে নিম্নস্তরেও সেল টিস্যু এবং ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটা ব্রেন টিউমার, ক্যান্সার, হতাশা, গর্ভপাতের মতো ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেলফোন টাওয়ারের স্ট্যান্ডার্ড তেজস্ক্রিয়তা ৫৮০-১০০০ মাইক্রোওয়াট পার স্কয়ার কিলোমিটার। ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে আরও কম। কিন্তু আমাদের দেশে বার বার বলার পরও কত থাকবে, কত আছে এসব নিয়ে কোনও পরিমাপ করা এবং মনিটরিং করার ব্যবস্থা নেই। এমনকি বিটিআরসির কাছে এই তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপের কোন মিটারও নেই। সূত্র বলছে, এতদিন ছিল না, তবে এখন পরিমাপের যন্ত্র কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই টাওয়ারগুলোর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয় পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তা নির্ণয়ে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও এরইমধ্যে কেটে গেছে ৫ বছর। সর্বশেষ গত মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন দিয়ে বলে, মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা উচ্চপর্যায়ের, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আট সপ্তাহের মধ্যে নীতিমালা তৈরি করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
তবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন্স সৈয়দ তালাত কামাল বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রটেকশন (আইসিএনআইআরপি)-এর নির্ধারিত বিকিরণ সীমার নিচে নেটওয়ার্ক স্থাপন ও পরিচালনা করে গ্রামীণফোন। এছাড়া, আন্তর্জাতিকভাবে মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।’

প্রকাশ :মে ৪, ২০১৭ ১২:০৩ অপরাহ্ণ