নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাগরের তলদেশে পাইপলাইনে ছিদ্র দেখা দেয়ায় আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পেতে আরও এক মাস সময় লাগবে। জাতীয় গ্রিডে শনিবার এলএনজি যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছিদ্র মেরামত শেষ না হওয়ায় আরও এক মাস পিছিয়ে গেছে।
পাইপলাইন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার কামরুজ্জামান বলেন, সাগর উত্তাল ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে যথাসময়ে পাইপলাইনের মেরামত করা যাচ্ছে না। শেষ করতে জুনের প্রথম সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ করতে আরও এক মাস সময় লাগতে পারে।
জানা গেছে, পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস সরবরাহ শুরুর পর এই ত্রুটি চিহ্নিত হয়। এই ত্রুটি সারাতে ১০টি স্থানে ওয়েল্ডিং করতে হবে। এজন্য এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) সরবরাহকারী এক্সিলারেট এনার্জির পরামর্শক কোম্পানি দ্য ওশেন আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছে দরপত্র চেয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আগামী ৪ জুন কাজ শুরু করে দুই সপ্তাহের মধ্যে শেষ করতে হবে। গত বৃহস্পতিবার দ্য ওশেনের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসেছেন। ইতিমধ্যে পাইপলাইন মেরামত কাজও শুরু হয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, সাগর ভাগের পাইপলাইনে কিছু ত্রুটি দেখা দেয়ায় নির্ধারিত সময়ে এলএনজি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তিনি আশা করছেন আগামী মাসের মধ্যে পাইপলাইনের ত্রুটি মেরামত করে এলএনজি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
এদিকে যথাসময়ে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত না হওয়ায় রোজাজুড়ে সারা দেশে গ্যাস সংকট অব্যাহত থাকবে। দিন দিন এ সংকট তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রামের আবাসিক গ্রাহকরা পুরো রোজায় গ্যাস সংকটে ভোগান্তি পোহাবেন। শুধু আবাসিক গ্রাহকই নয়, শিল্পকারখানাতে গ্যাস সংকট দেখা দেবে। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েছে জ্বালানি বিভাগ।
সংকট মোকাবেলায় ইতিমধ্যে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সবগুলো সার কারখানা ও বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তারপরও ঢাকা ও চট্টগ্রামে গ্যাস সংকট সামাল দিতে পারছে না তিতাস ও কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। ২৪ এপ্রিল দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির ভাসমান টার্মিনাল জাহাজটি কক্সবাজারের মহেশখালীতে পৌঁছায়। কথা ছিল ২৬ এপ্রিল থেকে ৯১ কিলোমিটার পাইপলাইন হয়ে প্রথম দফায় চট্টগ্রামের জাতীয় গ্রিডে ওই গ্যাস যোগ হবে।
এদিকে এলএনজি সরবরাহ শুরু না হওয়ায় ঢাকায় গ্যাস সংকটের সুরাহার কোনো পথ দেখছেন না তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিরাজমান গ্যাস সংকট তীব্র হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় সারাদিনেও একবার চুলা জ্বলছে না। নগরবাসীর অভিযোগ গ্যাসের চাপ না থাকায় সেহরি-ইফতারের আয়োজন করতে তাদের ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।
ঢাকা মহানগরীসহ তিতাসের আওতাধীন এলাকাতে বর্তমানে ৭০০ মিলিয়ন (৭০ কোটি) ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। সব মিলিয়ে সারা দেশে এখন গ্যাসের ঘাটতি ১১০০ মিলিয়ন (১১০ কোটি) ঘনফুট। এ অবস্থায় শিগগির এলএনজি না আসলে গ্যাসভিত্তিক সব খাতে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
এক লাখ ৩৩ হাজার ঘনমিটার এলএনজি নিয়ে ২৪ এপ্রিল মহেশখালী দ্বীপের কাছে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছায় এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশের বিশেষায়িত ভেসেল ‘এক্সিলেন্স’। ভাসমান ওই বন্দর (এফএসআরইউ) থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা যাবে বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। দু’দিন পরই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নয়, সব প্রস্তুতি শেষে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে এলএনজি যুক্ত হতে মে মাসের ২৫ কিংবা ২৬ তারিখ লাগবে।
কিন্তু সবশেষ নির্ধারিত তারিখে গ্যাস সরবরাহের কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়ায় যোগাযোগ করা হয় সরকারি সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মোহাম্মদ আল মামুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, জিটিসিএলের অধীনে থাকা মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইনটি প্রস্তুত। কিন্তু সমুদ্র থেকে মহেশখালী পর্যন্ত লাইনের কাজটি দেখছে আরপিজিসিএল।
আরপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার কামরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পাইপলাইনের কানেকশনে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। সাগর উত্তাল ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সেটা মেরামত করা যাচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এক্সিলারেটর এনার্জির জাহাজের পাইপলাইনের মাঝামাঝি স্থানে থাকা দুটি বক্সের সংযোগ খুলে গেছে। এতে গ্যাসের চাপ কমে যাচ্ছে। সাগরের তলদেশে সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনের ছিদ্র মেরামত করা খুবই জটিল ও দুরূহ।
জানা গেছে, এক্সিলারেটর এনার্জির জাহাজের সঙ্গে থাকা চারজন বিশেষজ্ঞ ডুবুরি প্রকৌশলী মেরামত শুরু করেছেন। তারা সাগরের তলদেশে গিয়ে এ কাজ করছেন। প্রতিবার ডুব দেয়ার পর ওই ডুবুরিরা সাগরের তলদেশে চার ঘণ্টা থাকতে পারেন। এরপর উপরে উঠে আসার পর কম করে হলেও ৬ ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে হয়। এভাবে প্রতিদিন তারা মেরামত করছেন। সাগর উত্তাল ও বৈরী আবহাওয়া হলে কাজ করা আরও কষ্টকর হয়ে পড়ে।
এদিকে এলএনজি সরবরাহ এক মাস পিছিয়ে যাওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে এক্সিলারেটর এনার্জি। একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের ওপর চাপ দিতে পারে। তবে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এলএনজি সরবরাহে দেরি হলে যে ক্ষতি হবে সেটা বাংলাদেশ সরকার নয়; ক্ষতির দায়ভার নিতে হবে এক্সিলারেটর এনার্জিকে।
তারা বলছে, চুক্তি অনুযায়ী এক্সিলারেটর এনার্জি বছরে ১১০ দিনের মতো গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে পারবে জাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে। এই সময়ও প্রতিষ্ঠানটি জাহাজের ভাড়া পাবে। জাহাজের ভাড়া, সেবা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে সরকার প্রতি বছর এক্সিলারেটর এনার্জিকে দেবে ৭২০ কোটি টাকা। ১৫ বছরে এ বাবদ দিতে হবে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত টার্মিনালের রিগ্যাসিফিকেশন বা তরল থেকে গ্যাসে রূপান্তরের ক্ষমতা রয়েছে দিনে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জুনের শেষে বা জুলাইয়ের শুরুতে এলএনজি সরবরাহ শুরু হলেও দেশে গ্যাসের সংকট দূর হবে না। কারণ হিসাবে তারা বলেছেন, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি ১১০ কোটি ঘুনফুট। আর এলএনজি থেকে পাওয়ার কথা রয়েছে ৫০ কোটি ঘুনফুট। সে ক্ষেত্রেও সমস্যা থাকবে। এলএনজি থেকে যে গ্যাস পাওয়া যাবে তার অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ কোটি ঘনফুট দেয়া হবে চট্টগ্রামে, বাকি অর্ধেক যাবে জাতীয় গ্রিডে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি